ঢাকা—এক নতুন দিগন্ত
ঢাকা, শহরের বুকের মধ্যে চাপা পড়া এক বিস্ময়। পুরনো ঢাকার গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রথম যখন নতুন শহরের আধুনিক দৃষ্টিতে চোখ পড়ল, তখন আমি ভেবেছিলাম, এই শহরের রহস্য শুধু সড়ক আর প্রাচীন স্থাপনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়—এখানে একটা গভীরতা, একটা ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। আমি বিদেশী পর্যটক, তবে এই শহরের হৃদয়ে ঢুকে আমি যেন নতুন একটি পৃথিবীতে প্রবেশ করেছি। যে শহরে পুরনো আর নতুন একসাথে চলতে থাকে। একদিকে খালি হাতে মানুষ রিকশায় চড়ে, অন্যদিকে সুদৃশ্য উঁচু বিল্ডিংয়ের মধ্যে কাঁচের দেয়ালে প্রতিফলিত হয় সূর্যের আলো। এ এক অদ্ভুত সম্মিলন।
শহরটি একদিকে উত্তেজনায় ভরপুর, আর অন্যদিকে শান্ত। ঢাকার গলিতে মানুষ অজস্র গল্প নিয়ে হেঁটে চলে। একদিকে ব্যবসায়িক ব্যস্ততা, অন্যদিকে রিকশার ঘন্টির শব্দ—সবকিছু মিলে এক অন্যরকম সুর সৃষ্টি করছিল। সব কিছুই অচেনা, তবে কিছু একটা পরিচিত। হয়তো এই শহরের সান্নিধ্যে আসতে পারলে আমি নিজের মধ্যে কিছুটা বদলাব।
লালবাগ কেল্লায় পৌঁছানোর আগেই আমি সেদিনের পথে পথভ্রষ্ট হয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, পুরান ঢাকার এই কেল্লা এক সময় মুঘলদের সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। কিন্তু এখন এটি এক অভিজ্ঞান স্থল, যেখানে স্থানীয়রা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গতিপূর্ণ গল্প বলে।
কেল্লার ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে হঠাৎ আমি একজন মেয়েকে দেখলাম। সে একটি বই পড়ছিল, তার পাশেই কিছু পাতা পড়ে ছিল। আমি ভেবেছিলাম, বুঝি কোনো শিক্ষার্থী, কিন্তু তার চোখের মধ্যে যা ছিল, তা আমাকে আকর্ষণ করেছিল। সে যেন ইতিহাসের সাথে কথা বলছিল, খুব মনোযোগ দিয়ে। তার গায়ের কালো জামা এবং ছিমছাম চুলগুলো পুরনো স্থাপনার সঙ্গে মিলে একটা অন্যরকম দৃশ্য তৈরি করছিল। আমি তখন সেই দৃশ্য থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না।
আমি দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে ভদ্রভাবে হাসলো, আর আমি অসাবধানে তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। "দুঃখিত, আপনি কি আমাকে কিছু সাহায্য করতে পারেন?" বললাম আমি।
সে আমাকে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে তারপর বলল, "এখানে একটু সাবধানে চলবেন, পুরনো দেয়ালগুলো খুব নরম হয়ে গেছে।"
এরপর শুরু হলো আমাদের কথোপকথন। আমি জানলাম, সে একজন স্থানীয় গাইড, যার নাম ছিল নুসরাত। কিন্তু সে কখনো নিজেকে গাইড হিসেবে পরিচয় দেয়নি, বরং সে ছিল এক সাধারণ মেয়ে—একটা উজ্জ্বল আত্মা, যার চোখে পুরো শহরকে স্নিগ্ধভাবে দেখার ক্ষমতা ছিল। তার কথায়, তার হাসিতে, আর তার ব্যবহারে আমি যেন নতুন একটি জীবনের সন্ধান পাচ্ছিলাম।