পুরুষ বা নারী বলতে একজন পুরুষ বা একজন নারীকে বুঝায়, আর নারী-পুরুষ বলতে সমগ্র নারী-পুরুষকে বুঝায়। কিন্তু নারী জাতি বা পুরুষ জাতি বলতে জগতের তাবৎ প্রাণীর মধ্যে নারী (মেয়ে) প্রজাতি ও পুরুষ প্রজাতিকে বুঝায়। তা বলে অত্র পুস্তকে “পুরুষ ও নারী জাতি” শিরোনামে যা কিছু আলোচিত হয়েছে, সেটাতে কদাচিৎ তাবত প্রাণীর উল্লেখ করা হলেও তা কেবল উপমা হিসেবে বলা হয়েছে, আদতে সৃষ্টির সেরা জীব, একমাত্র বাকশক্তিসম্পন্ন মানব জীবনের কথাই আসল প্রতিপাদ্য। শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জন্যই পৃথিবী প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম একেক রূপে সজ্জিত। মানুষ তা দেখেছে, তা থেকে শিখেছে, তার মূল্যায়ন করেছে এবং নিজের জীবনে প্রয়োগ ও উপভোগ করেছে। এটা সৃষ্টিকর্তার অকৃপণ দান। প্রকৃতির এ দানে গোটা জীব সমাজ (প্রাণী ও জড়) নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে, নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক ও সহযোগী হয়ে জীবনচক্র প্রবহমান রেখেছে। এ নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা, গবেষণা, বড় বড় পুথি-পুস্তক রচনা, জীববিজ্ঞানীদের আরাধনার বিষয়। তাই জগতের যাবতীয় প্রাণ (জড় ও জীব) সৃষ্টি ও বিকাশে যে প্রাণী সর্বাধিক উপকৃত ও সর্বোচ্চ সুবিধা প্রাপ্ত, তারই আলোচনায় ফিরে যাই। বলা হয় মনুষ্য প্রাণী সর্বশেষ সৃষ্টি হলেও সকল সৃষ্টির সেরা এবং সকল সৃষ্টির উপর ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী। তাই সে গর্ব যেমন আমাদের, তার কার্যক্রম অর্থাৎ ক্রিয়াপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ, পর্যালোচনা, সমালোচনা করার কর্তব্যও তেমনি আমাদের।
এ মানব অস্তিত্ব, সভ্যতা, ক্ষমতা যে অদৃশ্য শক্তির ওপর টিকে আছে, সেটা হলো প্রেম। প্রেমের মূলে রয়েছে আকর্ষণ, যা তাবত সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সৃষ্টিতে প্রাণসঞ্চার করেছে। আকর্ষণবিহীন জীবন, মৃত জীবন। কোনকিছু পাওয়া বা অর্জনের আকর্ষণ, অবলম্বন ধরে রাখার আকর্ষণ, সৃষ্টি করার আকর্ষণ, প্রেমের আকর্ষণ, সবই মহাকর্ষণের খণ্ড খণ্ড রূপ। এ বিশ্ব-মহাবিশ্ব সবই চলছে এক দুর্বার ও অবিচ্ছেদ্য চৌম্বক আকর্ষণে। উপগ্রহগুলো গ্রহের আকর্ষণে, আর গ্রহগুলো নক্ষত্রের মহাকর্ষণে গতি লাভ করছে। অসংখ্য নক্ষত্রমণ্ডল এক মহাজাগতিক আকর্ষণে মহাকালব্যাপী এক অজানা গন্তব্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সবের মূলেই মাত্রা ব্যতিক্রমে একই আকর্ষণ। অন্যকে কাছে টানার বা ধরে রাখার অদম্য ইচ্ছা বা শক্তিই বিভিন্ন প্রকার আকর্ষণরূপে কাজ করে। আর এ আকর্ষণের অন্য রূপ বা বিকল্প রূপ জীবজগতেও সঞ্চারিত হয়েছে প্রেমরূপে। জীবন মাত্রই প্রেম প্রত্যাশী অর্থাৎ আকর্ষণে বশীভূত। সকল জীবের সেরা মানব জাতি এ আকর্ষণকে বিভিন্নাচারে বিভিন্ন উপায়ে সমৃদ্ধ ও মধুময় করে, নাম দিয়েছে প্রেম। প্রেম মূলত মহাকর্ষণের এক সংক্ষিপ্ত রূপ। মানুষ ছাড়াও বিশাল বিস্তৃত জীবজগত, দৃশ্য-অদৃশ্য যাবতীয় সৃষ্টি, মায়াময় পৃথিবী, গৃহ-নক্ষত্র, সুবিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, যা বর্তমান ও গতিশীল, তার মূলেও প্রেম বা আকর্ষণ। স্থান, কাল, পাত্র, অবস্থান ও পরিস্থিতিভেদে প্রেমের ভিন্ন ভিন্ন নাম পরিচয় আছে। সে আলোচনাও এখানে থাক।
মহাকালের তুলনায় মানব জীবন (আয়ু) অতিসংক্ষিপ্ত, এ সংক্ষিপ্ত জীবনে মানুষ যা কিছু করে গেল, যা কিছু দিয়ে গেল, সেটাই তার অর্জন। মানুষ বলতে নর ও নারী। এ নরনারীই চলমান পৃথিবীর মূল জনজীবন। একবার কল্পনা করুন তো, মানুষবিহীন পৃথিবীর অবস্থাটা কী? নিশ্চয়ই বলবেন, সে অবস্থায় পৃথিবী মূল্যহীন। তাইতো মানুষ অর্থাৎ নরনারীর বিস্তৃত জীবনের কিয়দংশ এখানে আলোচনা হয়েছে।
আগেই বলেছি, সৃষ্টির মূলে রয়েছে প্রেম। সৃষ্টিকর্তা স্বীয় প্রেমাকর্ষণেই যাবতীয় সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবী সাজিয়েছেন, আর মানুষকে নিজাবয়বের অনুকরণে বানিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, অনেক গভীর প্রেমাসক্ত হয়ে। তাইতো বলা হয় স্বর্গ হতে আসে প্রেম, স্বর্গে যায় চলে। প্রেম যদি পৃথিবীতে স্থিত হতো, তবে এখানে হিংসা, দ্বেষ, হানাহানি, মারামারি অন্যায়-অত্যাচার হতো না, সর্বক্ষণ পৃথিবীময় সুখ শান্তি, আরাম ও ভালোবাসা বিরাজ করত। এখানে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় আর দুঃখ অশান্তির সৃষ্টি হয়। এখানে স্রষ্টা প্রদত্ত স্বল্প প্রেমের ক্ষুদ্রাবলম্বন নর ও নারী। এই সামান্য (যা অতি মহৎ) প্রেমের কতশত উপখ্যান সৃষ্টি করেছে মানুষ, তার ইয়ত্তা নাই। পুথি, কবিতা, নাটক উপন্যাস ও গল্পের শতকরা নব্বই ভাগই প্রেমোপাখ্যান। মনে হয় সাহিত্য জগতটা প্রেমের ওপরই টিকে আছে। পুরুষের আকাক্সক্ষা, নারীর কামনা, বেদনা, বিলাপ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে যেসব মহাকাব্য রচিত হয়েছে, তা-ই পৃথিবীর সাহিত্য সম্ভার। এখানে উপজীব্য হলো নর ও নারী। এ দুয়ের আকর্ষণানুভূতিই প্রেম। এ প্রেমানুভূতি ক্রমে কামানুভূতির জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রে কামানুভূতিই প্রেমে পরিণত হয়, যা তাবৎ সৃষ্টিতত্ত্বের মূল প্রক্রিয়া। এর ব্যতিক্রমে জগতে কোন সৃষ্টিই চলমান থাকতো না। তাইতো সাধক সম্রাট লালন বলেছেন “কাম ছাড়া তোর প্রেম হবে না” আর মহাকবি নজরুল বলেছেন “চির যৌবনা ইহার শিবনয়, কামরতি।” এ অমর বাক্য সব শুধুমাত্র নর ও নারীর জন্য প্রযোজ্য।
হে মানুষ, তুমি সৃষ্টির সেরা জীব। সারা পৃথিবী তোমার বিচরণ ক্ষেত্র, তাবৎ সৃষ্টি তোমার অধীন, তুমি এ মহান পৃথিবীর শাসক, তোমার যথেচ্ছ উপভোগ্য সামগ্রী পৃথিবী উৎপাদন করে, তুমি ভোগ করো, অথচ তোমার জীবনচক্র শুধু দুজনায় সীমাবদ্ধ, এক নর আরেক নারী। এটা মহান সৃষ্টিকর্তার মহোত্তম দান, তুমি এর মূল্যায়ন করো। পৃথিবীতে শান্তির আবাস গড়ে তোলো, ধরিত্রী মাতাকে ধন্য করো আর তোমার সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য সফল করো।