তাহেরুদ্দীন মল্লিক এক বিরলপ্রজ সাহিত্যসাধক। সাহিত্যের প্রান্তরের এই নীরব পরিব্রাজক সাহিত্যসাধনা করে গেছেন নিভৃতে অথচ নিষ্ঠানৈপুণ্যে। ধর্মচেতনাসহ তাঁর সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তু কালের নিরিখে প্রাসঙ্গিকতাপূর্ণ। তাঁর বৈদগ্ধের স্ফুরণ আর মনস্তত্ত্বের ছায়াপাত ঘটেছে সেসব সাহিত্যকর্মে।
শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজনে শুধু নয়, সামাজিক দায়িত্ব পালনের তাড়না থেকেই মানুষের সঙ্গে সুগভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মননশীল তাহেরুদ্দীন মল্লিকের। আপন তাগিদে বিস্তৃত সেই অন্তর্জাল কালের পথ বেয়ে রূপ নিয়েছে সাহিত্যের। তাঁর 'চেনামানুষের জারী' সেই সম্পর্ক উন্নয়নের প্রামাণ্য দলিল। এটি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সাহিত্যকর্ম। একটি জেলায় একশো চৌষট্টি জন স্বনামখ্যাত সাহিত্যিকের জন্ম-এটা যেমন নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তার চেয়েও বিস্ময়কর হলো এই সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে ছিল তাহেরুদ্দীন মল্লিকের সম্যক ও সুনিবিড় ধারণা, যা তিনি প্রত্যেকের জন্য তুলে ধরেছেন মাত্র চার লাইনে। এও তাঁর অনন্য সাহিত্যসাধনার বহিঃপ্রকাশ। সাহিত্যের প্রতি শিশু-কিশোর-তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা তাহেরুদ্দীন মল্লিকের ঐকান্তিক দরদের সাক্ষ্য দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত তাহেরুদ্দীন মল্লিকের পঠন-পাঠন ছিল যে কোনো 'উচ্চশিক্ষিত' ব্যক্তির চেয়ে অনেক ধাপ এগিয়ে। এই অধ্যয়ন-মানস তাঁর ভেতরে জন্ম দিয়েছিল সাহিত্য-সংগঠন প্রেমের।
জীবিকার প্রয়োজনে তিনি বিচিত্র কর্মপেশায় নিয়োজিত ছিলেন। মানুষের কোনো সৎ কর্মই যে অপাঙ্ক্তেয় নয়, তাহেরুদ্দীন মল্লিক তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। মানুষটি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। 'গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনার উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা' গ্রামের পশ্চাদপদ মানুষের জন্য তাঁর মঙ্গলচিন্তার কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে রাজনীতির কদর্যতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। শ্যাওলা জমা রাজনীতির মাঠে খুব সাবধানে তিনি পা ফেলেছেন। তাই হয়তো অনেকের মতো 'অগ্রসর' হতে না পারলেও পিছলে পড়েননি। এখানেই আমাদের কাছে নমস্য তিনি।