বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় ছড়াকার ছড়ার রাজা হানিফ রাজা রচিত ছন্দে গড়া স্বদেশ আমার নামক ছড়াগ্রন্থের ছন্দোবদ্ধ বক্তব্যের শাব্দিক গতিময়তা, অর্থের প্রবাহমানতা, শব্দের নির্যাস ও বৃত্তের বিন্যাস আমাদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। এ গ্রন্থের অলঙ্কারিক, শৈল্পিক, সৌরিক ও সাহিত্যিক উন্নয়নের সরোবরে ছড়াকাব্যের শ্লোক মানব মনের নানান অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে। হানিফ রাজার ছন্দে গড়া স্বদেশ আমার গ্রন্থে নানান অনুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি ১৯৭১ এর সুদীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার দামাল ছেলেরা যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল সে স্বাধীনতার ছান্দিক বর্ণনা ফুটে উঠেছে। যেমন তিনি ১৬ই ডিসেম্বর নামক ছড়ায় বলেন,
বাংলা মায়ের দামাল ছেলে
অস্ত্র নিলো হাতে,
দেশের প্রেমে যুদ্ধ করে
পাক হায়েনার সাথে।
এর পাশাপাশি তিনি আমাদের দেশের কোটাপ্রথার ক্ষতিকর দিকগুলো শক্ত ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন তিনি কোটাপ্রথা নামক এক ছড়াপদ্যে বলেন,
মেধার নামে চলছে নাটক এই দেশেতে ভাই,
কোটার ফাঁদে মেধাবী আজ কর্মসংস্থান নাই।
প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে তরুণ ছাত্র দল,
অদম্যরা যায় এগিয়ে বুকে নিয়ে বল।
এর পর তিনি ২৪ এর গণ আন্দোলনের শহীদ মীর মুগ্ধের কথাও ছড়ায় ছড়ায় তুলে ধরেছেন। যার নাম মুখে নিলেই মনে পড়ে ঢাকার রাজপথে তাঁর শ্রুতিমধুর কণ্ঠে ভেসে আসা ঐতিহাসকি প্রতিধ্বনি «পানি লাগবে পানি?»। একই চরণে তিনি তুলে ধরেছেন রংপুরের সূর্যসন্তান শহীদ আবূ সাঈদের কথা।
আন্দোলনে ঝাঁপায় পড়ে রাজপথ ছাড়ে নাই,
সংস্কার যুদ্ধে শহীদ হলো মুগ্ধ-সাঈদ ভাই।
ছড়ার একদম শেষপ্রান্তে এসে তিনি কোটা আন্দোলনের সফল ফলাফল তুলে ধরে বলেন,
অবশেষে বিলীন হলো
কোটা প্রথার কাজ,
মেধা দিয়ে হবে চাকরি
সবাই খুশি আজ।
শুধু স্বাধীনতা, আন্দোলন ও সংগ্রামের কথা বলেই ক্ষান্ত হননি তিনি। বাংলাদেশের রূপসৌন্দর্যের নৈসর্গিক বর্ণনা দিতেও ভুলেননি এই প্রতিভাধর ছড়াকবি। যেমন তিনি ছয় ঋতুর দেশ নামক ছড়াকাব্যে স্বদেশের রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন,
বাংলা আমার রূপের বাহার
ফুল ফসলে ভরা,
সবুজ সাজে মাঠের মাঝে
রূপে রঙে ধরা।
এরপর তিনি রাত পোহালে ভোরের আলো ফুটে ওঠলে প্রকৃতির কোলে নদীর জলে এবং সুরের তালে বৃক্ষের ডালে যে অবিরাম শৈল্পিক সৌন্দের্যের দৃশ্য ফুটে সে দৃশ্য বড়ো চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
ভোরের বেলা পাখির খেলা
কিচিরমিচির সুরে,
নদীর জলে ছলাৎ ছলে
খেয়া চলে দূরে।
অতঃপর কবি দৃষ্টি দিয়েছেন আমাদের দেশ থেকে প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া ঐতিহ্য নকশীকাঁথার দিকে। আমাদের দেশের গ্রামঞ্চলের নারীরা পাতলা কাপড়, প্রধানত পুরানো কাপড় স্তরে স্তরে সজ্জিত করে নকশী কাঁথা তৈরি করতেন।
গ্রামীণ নারীরা যেমন নকশীকাঁথায় ফোঁড় দেয়ার নৈপুণ্যের গুণে বিচিত্র বর্ণের নকশা, বর্ণিল তরঙ্গ ও বয়নভঙ্গির প্রকাশ ঘটান সে রকমভাবে শুি সাহিত্যিক ও ছড়াকবি হানিফ রাজা শব্দের পর শব্দ বসিয়ে বিচিত্র ও বিভিন্ন ধরনের বৃত্তছকে ভাবের তরঙ্গ দিয়ে নকশীকাঁথা ছড়াকাব্যটির ভাষিক ও শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। যেমন তিনি নকশি কাঁথার স্মৃতি নামক পদ্যে বলেছেন,
নকশি কাঁথার বাহার ছিলো বাংলার পল্লী গাঁয়ে,
কাঁথার মাঝে নকশা করতো পাড়াপড়শির মায়ে।
মনের ছবি উঠতো ভেসে নকশি কাঁথার মাঝে,
অবসরে কাটতো সময় কাঁথা সেলাই কাজে।
এরপর তিনি একটু এগিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে খানিকটা আক্ষেপের সুরে বলে ওঠেন,
উঠোন মাঝে মাদুর পেতে সেলাই করতো কাঁথা, নকশি কাঁথার রূপ কাহিনি এখন স্মৃতির পাতা।
দেশের কথা, দশের কথা, প্রকৃতির কথা, প্রগতির কথা বলতে বলতে শেষ পর্যায়ে এসে তিনি খানিকটা নিজের কথাও বলেছেন। যেমন তিনি পরিচয় নামক পদ্যে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন,
ময়মনসিংহ জেলায় বাড়ি তারাকান্দা থানা, থাকি আমি ত্রিশিয়া গ্রাম সবার নেই কো জানা।
মানুষ হয়ে উড়ে বেড়াই যেনো মুক্ত পাখি, গাও গেরামের ছবি দেখি মেলে দুটি আঁখি।
এভাবেই সমকালীন ছড়াকার কবি হানিফ রাজা বাংলার স্বাধীন নীল আকাশে মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে স্বদেশের নৈসর্গিক সবুজ সৌন্দের্যের রস টেনে প্রতি পরতে পরতে প্রতিনিয়তই বাংলা ছড়া সাহিত্যকে নানান আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। আমরা তাঁর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, সফলতা ও সতেজতা কামনা করি। তাঁর সম্পর্কে মামুন বিন হারুন বলেন,
❝ একদিন বাংলা ছড়া সাহিত্যের আকাশে হানিফ রাজা নামটা রাজকীয় ভঙ্গিমায় জ্বলজ্বল করে জ্বলবে। ❞
তিনি ছড়া সাহিত্যের একনিষ্ঠ সাধক হয়ে গোটা একটা জীবন অনায়াসেই কাটিয়ে দিক এ প্রত্যাশাই করি।
বাংলা ভাষা দীর্ঘজীবি হোক।
মামুন বিন হারুন
পরিচালক, বাংলা বুকডেমি