বিয়ের ব্যাপারে মহেন্দ্রের অনিচ্ছা যে নিতান্তই অসার ও হাস্যকর এর পরেই তা স্পষ্ট হলো। বিধবা কাকি অন্নপূর্ণার প্রতি সমবেদনা দেখাতে গিয়ে সে তার বোনঝি আশালতার সঙ্গে বন্ধু বিহারীর বিয়ের সম্বন্ধ করে। কিন্তু পাত্রী আশাকে দেখে সে এতই বিমোহিত হয় যে মায়ের অসম্মতি ও বন্ধুর আশাভঙ্গ সমস্ত উপেক্ষা করে তাকেই বিয়ে করে বসে। এই বিয়েই মহেন্দ্রের ভবিষ্যৎ জীবনে অনেক সংকটের সৃষ্টি করেছে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সেগুলি নির্দেশ করেছেন এভাবে : প্রথমত, মহেন্দ্রের একান্ত স্বার্থপরতা ও প্রবৃত্তিবশ্যতা উৎকটভাবে অভিব্যক্তি পেয়েছে। নাটকীয়ভাবে প্রকটিত হয়েছে তার আত্মচরিত্রজ্ঞানের অভাব। দ্বিতীয়ত, বধূর প্রতি রাজলক্ষ্মীর বিরাগ প্রাত্যহিক সংসারজীবনে একটা বিরোধ-তিক্ততা সৃষ্টি করে পারিবারিক সংহতিকে শিথিল ও ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদের সম্ভাবনাকে সুগম করেছে। তৃতীয়ত, বিহারীর মনে আশা সম্বন্ধে একটা গোপন দুর্বলতার রন্ধ্রপথ উন্মুক্ত রেখে তার হিতকর মধ্যবর্তিতাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। চতুর্থত, আশার নিজের সঙ্কুচিত মনোভাব ও অতিকোমল পরনির্ভরতা তার বধূমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবার পথে অন্তরায় হয়েছে এবং মহেন্দ্রের উচ্ছ্বঙ্খলতা-সংযমনে তার শোচনীয় অক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।
দাম্পত্য জীবনের সূচনায় মহেন্দ্র-আশার মধ্যে পারস্পরিক আন্তরিক অনুরাগ ছিল। কিন্তু মহেন্দ্রর ঊচ্ছ¡সিত প্রণয়াবেগ ও আশার বিমোহিত প্রেম-বিহ্বলতা সত্ত্বেও তাদের দুজনের জীবনে যে মর্মান্তিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাতে মুখ্য ভ‚মিকা মহেন্দ্রর হলে গৌণ ভ‚মিকা আশার। অভিনিবেশ সহকারে দেখলে বিনোদিনীর ভ‚মিকা মুখ্য বলে গণ্য হয় না। তার মন-ভোলানো হাবভাব, তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও তার অনন্য কর্মকুশলতা সত্তে¡ও একথা অনস্বীকার্য যে মহেন্দ্র-আশার আপাতমধুর দাম্পত্য জীবনে কোনো দুর্বল রন্ধ্রপথ না থাকলে বিনোদিনীর পক্ষে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরানো সম্ভব ছিল না।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।