উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ভারতবর্ষ পত্রিকায় ১৯১৫ সালে। লেখক উপন্যাসে সকল অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে উপন্যাসের নায়ক রমেশকে সচেতন যুবক এবং দ্রোহ ও বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে ঐ সময়ে উপন্যাসটি সাড়া ফেলে এবং সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। সে সময়ে বিভিন্ন শ্রমিকশ্রেণির সামাজিক আন্দোলনের ইশতেহার রূপে কর্মীদের মাঝে উপন্যাসটির কিছু কিছু অংশ হাতে লিখিত আকারে প্রচারিত হয়। অতঃপর উপন্যাসটি ১৯১৬ সালে মানে এখন থেকে প্রায় ১১০ বছর পূর্বে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। সে সময়ে বাংলার তথা পল্লী-সমাজের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। আর কৃষি ছিল জমিদারনির্ভর। সে সময়ে জমির মালিক ছিল জমিদার। জমিদাররা ছিল সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাদবাকি চাষাভুষারা ছিলেন প্রজা। তারা জমিদারের জমি বর্গাচাষ করতেন।
সেরকম দুইটি জমিদার পরিবারের পারিবারিক কলহের জের ধরে উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়। দুই জমিদার পরিবারের একটি পরিবার মহাকুলীন বলরাম মুখুজ্যের ছেলে যদু মুখুজ্যের মেয়ে রমা। অন্য পরিবারটি হলো বলরাম মুখুজ্যের মিতা বলরাম ঘোষাল পরিবারের রমেশ এবং বেণী মাদব ঘোষাল। বলরাম মুখুজ্যে শুধু কুলীন ছিলেন না, তিনি ছিলেন অনেক বুদ্ধিমান এবং বর্ধমান রাজ সরকারের চাকুরিজীবী। সেই সুবাদে তিনি বর্ধমান সরকারের কাছে কুঁয়াপুরের জমিদারী লিখে নেন এবং বলরাম মুখুজ্যে তার মিতা বলরাম ঘোষালকে নিয়ে বিক্রমপুর থেকে এই গ্রামে আসেন। গ্রামটির নাম কুঁয়াপুর। বলরাম ঘোষালের বিয়েকে কেন্দ্র করে দুই বন্ধুর মধ্যে মনোমালিন্য হয় এবং শেষ অবদি দুই বন্ধুর বন্ধুতা এমন বিবাদে রূপ নেয় যে বছর বিশেক তাদের পরস্পরের মুখদর্শন বন্ধ থাকে। অতঃপর মৃত্যুকালে বলরাম মুখুজ্যে নিজের সমস্ত সম্পদ আপন সন্তান যদু মুখুজ্যে ও বন্ধুর দুই সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দেন। সেই থেকে কুঁয়াপুরে এই দুই পরিবারের প্রধান্য। মূলত পরিবার ও পারিবারিক কলহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও উপন্যাসটি পুরো সে সময়ের একটি সমাজ ব্যবস্থাকে ফুটিয়ে তুলেছে।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।