আমার বাবা ১৯৭১ সালে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে আর ঘরে ফিরেনি। বাবাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুলি করে মেরে ফেলেছে। বাবার মৃত্যু নিশ্চিত করতে পাকিস্তানিদের হয়তো একটি বা দুটি বুলেট প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমার মা যতদিন দুনিয়ায় বেঁচে ছিলেন ততদিন লক্ষ লক্ষ বুলেট তার বক্ষ বিদীর্ন করে গেছে। সেই বুলেটে তিনি মারা গেলে হয়তো কষ্ট কম পেতেন, কিন্তু যে বুলেট আমৃত্যু বুকে বয়ে বেড়াতে হয় সেই বুলেট খুবই বেশি কষ্টের। সন্তানদের গায়ে জামা ছিল না, পেটে খাবার ছিল না, স্কুলের বেতন ছিল না, পড়ার টেবিলে বই ছিল না, তার বাবা ও তার সন্তানকে মানে আমার নানা ও আমার ভাইকে রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সুচিকিৎসার অর্থ ছিল না, এইসব দুর্যোগগুলো প্রতিটিই ছিল একেকটি বুলেট। বাবার যুদ্ধটা ছিল স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব ও লাল সবুজের পতাকার জন্য। আর মায়ের যুদ্ধটা ছিল সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য, গায়ে কাপড় তুলে দেয়ার জন্য, পড়ার টেবিলে বই তুলে দেয়ার জন্য ও ছেলেমেয়েদের অসুস্থ্যতায় ওষুধ এনে দেয়ার জন্য! আমার মায়ের জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট ছিল এতো বড় এই পৃথিবীতে তার স্বামীর কোনো কবর ছিল না! তিনি তার কবরের সামনে গিয়ে কখনো দাঁড়াতে পারেননি। এর পরের কষ্টগুলো ছিল নিজের চোখের সামনে তাঁর বাবা-মায়ের মৃত্যু, ছেলেমেয়ের অকাল মৃত্যু, নাতির অকাল মৃত্যু। অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুগুলোই আমার মায়ের মৃত্যুকে তরান্বিত করেছে।
একজন মানুষের জীবনে তার মা শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, আমার মাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমার মায়ের যাপিত জীবন সংগ্রামই এই উপন্যাসের মূল প্রেরণা। যে লড়াই তিনি অহর্নিশি নীরবে লড়ে গেছেন, তাই নিয়েই এগিয়েছে এই গল্প। আমি চেয়েছি, এই বইটির ভেতর দিয়ে আমার মায়ের জীবনের গভীরতম মানবিক দিকগুলো অনির্বাণ আলো হয়ে জেগে থাকুক।
মায়ের জীবনের শেষ দিনগুলোতে তার সান্নিধ্যে থাকতে না পারা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টের কারণ। মা ভৌগোলিক ভাবে দূরে থাকলেও মানসিক ভাবে আজন্ম কাছেই ছিলেন, এখনও আছেন।