‘১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর এর্নেস্তো চে গুয়েভারার সম্ভাব্য মৃত্যুর খবর পৌঁছল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।’ লিখছেন জন জেরাসি (চে’র নির্বাচিত রচনা’র সম্পাদক এবং চে-বিশেষজ্ঞ)। পরের দিন সানফ্রানসিসকো স্টেট কলেজে ক্লাস নিতে ঢুকছি; বিষয়বস্তু, তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ এবং বিপ্লব। একটি উনিশ বছরের মেয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। “খবরটা সত্যি নয়। তাই না? চে কিছুতেই মারা যেতে পারে না পারে কি?”
‘স্বভাবতই আমাদের ক্লাসে চলল বিষয়বস্তুর পরিবর্তে চে’কে নিয়ে আলোচনা। তার গেরিলা যুদ্ধের তত্ত্ব, তাঁর বিশ্বাস, তাঁর মতাদর্শ সবিস্তারে আমরা আলোচনা করলাম। আশ্চর্যের বিষয়, আমরা কেউই সেই মুহূর্তে চে’র মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করিনি।’
১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে একমাত্র কিছু সাম্রাজ্যবাদের দালাল ছাড়া আর কেউই চাননি চে’কে মৃত দেখতে। কারণ তারা বিশ্বাস করতেন, চে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের মুক্তির জন্য যারা শোষিত, নিপীড়িত, পদানত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত তৃতীয় বিশ্বসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা, পুঁজিবাদের দ্বারা, মৌলবাদের দ্বারা, একনায়কতন্ত্রের দ্বারা।
চে’র জন্ম হয়েছিল ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে। তার বাবার নামও আর্নেস্তো। তিনি ছিলেন এক রোমাঞ্চ-অন্বেষী মানুষ। জীবনে তিনি রোজগার করেছেন যত, খুইয়েছেন তার থেকেও বেশি বিভিন্ন ব্যবসায়ে। জাহাজ নির্মাণ, মাতে (এক ধরনের আর্জেন্টিনিও চা) এবং জমি কেনাবেচার ব্যবসায়। অবশেষে স্থাপত্যবিদ্যায় কোনো ডিগ্রি ছাড়াই হয়ে উঠলেন একজন স্থপতি। একজন মুক্তমনের অধিকারী ছিলেন এই সিনিয়র আরর্নেস্তো।
চে’র মা সেলিয়া দে লা সেরনা এক অভিজাত বংশের সন্তান। দৃঢ়চেতা, গরিবদরদি এই মহিলা জীবনের শেষে মার্ক্সবাদকেই মতাদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন।
জীবনের বেশিরভাগ সময় চে’র পরিবার এক জায়গায় থিতু হয়ে বসতে পারেননি। তাঁদের প্রথম সন্তান চে’র জন্মের সময়ে তাঁরা ছিলেন রোসারিওতে। তখন তাদের মাতে চাষের ব্যবসা ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই চে’র বাবা চলে যান। বুয়েন্স আয়ারসে এবং যোগ দেন জাহাজ নির্মাণ ব্যবসায়। এই সময় চে’র মারাত্মকভাবে ঠাণ্ডা লাগে। দেখা দেয় কঠিন হাঁপানি, যা চে’র নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল। ডাক্তাররা বলল বুয়েন্স আয়ারসের সাঁতসেঁতে আবহাওয়া হাঁপানি রোগীর উপযুক্ত পরিবেশ নয়। অতএব নামমাত্র টাকায় জাহাজ ব্যবসার শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে সিনিয়র আর্নেস্তো চললেন পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত স্বাস্থ্যোদ্ধারের শহর আলতা গ্রাসিয়ায়। তখন চে’র বয়স চার বছর।
আলতা গ্রাসিয়াতে শুধুমাত্র দু’ধরনের মানুষই থাকত একদল যারা বড়লোক, আর অন্যদল যারা গরিব। বড়লোকেরা থাকত সারি সারি বাংলোবাড়িতে। এগুলো এক ইংরেজ কোম্পানি তৈরি করেছিল তাদের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের থাকার জন্য। চে’রা থাকতেন শহরের বড় রাস্তার ওপরে ভিলা লিসিয়া নামে এক বাংলোবাড়িতে। বাড়ির পেছনে ছিল গলফ ক্লাব। ছোট বয়সেই চে গলফ খেলায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন।
চে’দের বাড়িতে সব বাচ্চাই খেলতে আসত। কার বাবা কী কাজ করে তা নিয়ে চে’র মা-বাবার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সবার জন্য ছিল অবারিত দ্বার।
আলতা গ্রাসিয়ায় চে’র স্বাস্থ্য ফিরে যায়। কিশোর চে’কে দেখে বোঝাই যেত যে তিনি ছোটবেলায় অত রোগা ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় এই বয়সেই চে বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ করতেন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। আঙুরের ক্ষেতে আঙুর তোলার কাজ অথবা কোনো রেস্তোরাতে বয়ের কাজ। শোনা যায় একবার এক জন্মদিনের পার্টিতে ময়লা জামাকাপড় পরে আসার জন্য তাঁকে হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
হাঁপানির জন্য যখন বাইরে বেরনো নিষেধ তখন চে বই পড়তেন। বাড়িতে বাবার বিশাল লাইব্রেরি, প্রায় ত্রিশ হাজার বই তাঁর বাড়িতে ছিল। সব ধরনের বই চে পড়তেন। শুধুমাত্র ধর্মপুস্তকে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। দর্শন, সমাজবিদ্যা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সব বিষয়েই চে’র ছিল গভীর আগ্রহ। চে’র এক বন্ধুর জবানিতে জানা যায়, চে তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সে ফ্রয়েডও পড়েছিলেন। মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলেন ফরাসি। চে ফরাসি কবিতা আবৃত্তি করতে খুব ভালোবাসতেন। কবিতা খুব প্রিয় ছিল তার এবং একসময় ভেবেছিলেন কবি হবেন। ১৯৫৬ সালে কিউবার বিপ্লবের সময় একটি কবিতা লিখেছিলেন চে‘ফিদেলের জন্য গান’। পাবলো নেরুদার অনুগত পাঠক ছিলেন তিনি। স্পেনের গৃহযুদ্ধের ওপর লেখা নেরুদার কবিতাগুলো তার খুব প্রিয় ছিল।
হাঁপানির জন্য চে স্কুলে যেতে শুরু করেন সাত বছর বয়সে এবং মাঝে মাঝেই কামাই হতো। তার ভাইবোনেরা স্কুল থেকে পড়া জেনে এসে তাকে বলত।
১৯৪১ সালের চে’র পরিবার আলতা গ্রাসিয়া থেকে কোরদোবায় চলে আসেন। এখানে তিনি হাইস্কুলে ভর্তি হন। তখন তার চুল ছিল ছোট ছোট করে ছাঁটা। পোশাকপরিচ্ছদের দিকে নজরই ছিল না। তাই বন্ধুরা কটাক্ষ করত। তেরো বছর বয়সে বাবার অনুমতি নিয়ে চে আর্জেন্টিনা দেখতে বেরোলেন একটা সাইকেলে চেপে। গায়ে চামড়ার কোট, পিঠে একটা ঝোলা আর সঙ্গে মাতে তৈরির কেটলি। পকেটে মাত্র ৭৫ পেসো। কখনও হাঁপানিতে কাতর হয়ে রাস্তার ধারেই শুয়ে থেকেছেন। কখনো থেকেছেন অভুক্ত। এভাবে দেশের সমগ্র উত্তরভাগ ভ্রমণ করে ফিরেছেন নিজের শহরে স্কুল শুরু হওয়ার ঠিক আগেই।