এই বইয়ে চৌদ্দটি গল্প আছে। চৌদ্দটি গল্পে চৌদ্দ রকমের কাহিনি আছে- একটির সঙ্গে অন্যটির কোনও মিল নেই। প্লট, চরিত্র ও বর্ণনায় আছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। সব গল্পই উত্তম পুরুষে লেখা হয়েছে, একটি বাদে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে মনোলগ। এটিই বাসার তাসাউফের লেখালিখির স্বতন্ত্র ধাঁচ। জীবনের গভীরে তার অনুসন্ধিৎসু অভিগমন আছে। তাই গল্প সাজাতে গিয়ে কাল্পনিক পথে খুব বেশি হাঁটতে হয় না। তাঁর গল্পের কাহিনিতে অভিনবত্ব, সুচারু ভাষাশৈলী, কাব্যিক বর্ণনা- ক্লান্তিকর পাঠের অস্বস্তিতে পড়তে হয় না পাঠককে। ঘটনা বর্ণনায় মেদ কিংবা অসংযত আবেগের প্রকাশ নেই। একই সঙ্গে কালাকাল, উত্তরণ-সন্তরণ অতিক্রম করে বাস্তবের গাছতলায় আশ্রয় নেয়। এখানেই বাসার তাসাউফের গদ্যভাষা ব্যতিক্রমী।
গল্পের বইয়ে একসঙ্গে কয়েকটা গল্প পড়া যায়। এতে সুবিধা যেমন আছে অসুবিধাও আছে। সুবিধা হলো- একটি দীর্ঘ স্কেপের মধ্যে বা দৃশ্যের পর দৃশ্য চিহ্নিত করতে করতে পাঠ চালিয়ে যাওয়া যায়। আর অসুবিধা, মনোটনি। তবে এই বইয়ের গল্পগুলোর বিষয়-বৈচিত্রের কারণে সেটা অতিক্রম হয়ে গেছে। এছাড়াও প্রতিটি গল্পের ভাষা সহজ ও প্রাঞ্জল। ছোট-ছোট শব্দ, বাক্য গঠন, উপমা, কাঠামো, কাহিনিতে বৈচিত্র ও অনুপম কাব্যিক গদ্য পাঠককে বুঁদ করে রাখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। প্রথম গল্প ‘এলেন পোর বিড়াল হয়ে এসেছিল’ থেকে ‘ইউ টার্ন’, ‘কখনও মাস্টার হতে চাইনি’, ‘একই আকাশের নিচে’, ‘তৃতীয় প্রজন্ম’, ‘দিব্যনারী’, ‘চোখের মধ্য দিয়ে মনের ভেতরে’, কিংবা ‘বিষণ্ন স্মৃতির প্রসন্নতায়’ গল্পগুলোতে গদ্যের সরু সাঁকোতে স্বচ্ছন্দ হেঁটে বেরিয়েছেন লেখক, সঙ্গে পাঠকও হেঁটে যেতে পারে তরতর করে। এটাই বোধহয় সার্থক শিল্পের আয়না। যেখানে নিজের প্রতিবিম্ব দেখার পাশাপাশি পাঠককেও দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
আদিমকালের গুহাচিত্রের সাংকেতিক রেখা নয়, আধুনিককাল বা উত্তরাধুনিককালের রিয়েলিজম বিমূর্ত ক্যানভাসে শিল্পের মৌলিকতা ও অভিনবত্ব প্রকাশিত হয়েছে এই বইয়ের গল্পগুলোতে।
বাসার তাসাউফের লেখালিখি শুরু শৈশবে-কৈশোরেই। তখন স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে তথাকথিত ‘আউট’ বই নিয়ে দিন-রাত নিমগ্ন থাকত আর ছড়া-কবিতা লেখার চেষ্টা করত বলে বাড়ির লোকেরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। অনেকে ভর্ৎসনা করে বলত, ‘ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে এসব নিয়ে মজে থাকলে শেষে না আবার পস্তাতে হয়।’
শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে এসেছে বহুদিন হলো। মধ্যযৌবনে এসে যখন ছড়া-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, থ্রিলার, রম্য, নন ফিকশন, শিশুতোষ ও কিশোর উপযোগী- সব মিলিয়ে ১৮টির মতো বই প্রকাশ হয়ে গেছে- এখনও বাড়ির লোকেরা সেই অমোঘ কথাগুলো বলে বেড়ায়। কিন্তু কথাগুলো এখন আর তাকে বিচলিত করে না। সে বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে সব মানুষ সফল হয় না। কেউ কেবল বেঁচে থাকে, কেউ আবার কোনোমতে টিকে থাকে। বাসার তাসাউফ কেবল বেঁচে থাকতে চায়নি, চেয়েছে কোনমতে টিকে থাকতে। টিকে থেকে দেখতে চেয়েছে এই পৃথিবীর এমন কিছু বিষয়- যা অন্য কেউ দেখেনি। রাতের নির্জনে যে টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ে, ফসলের মাঠ থেকে ভেসে এসে শিয়ালের ডাক আর ঝিঁঝি পোকার কোরাস যে মনের গহীনের বিষাদের আবহ তৈরি করে- তা কি কেউ শুনতে পেয়েছে কখনও? কেউ কি অবগাহন করেছে নারিকেল গাছের চিরল পাতার ফাঁকে জেগে থাকা পূর্ণিমার চাঁদের অবারিত আলোর বন্যায়? উপভোগ করেছে কি মেঘ জমে থমথমে আকাশ থেকে উপচেপড়া ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দ? হয়তো আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মাথার ওপরে ছাদ থাকলে বৃষ্টির শব্দ হয় উপভোগ্য আর পায়ের তলায় মাটি থাকলে হাওয়াই চপ্পলের শব্দও নূপুরের নিক্কণ ধ্বনি মনে হয়। বাসার তাসাউফ আকাশকে ছাদ আর মাটিকে অকৃত্রিম নির্ভরতা মেনে এই পৃথিবীতে দিন যাপন করে চলেছে। সফল ও ব্যর্থ মানুষে ভাগ হয়ে যাওয়া সমাজ-বাস্তবতায় স্বেচ্ছায় আপন করে নিয়েছে নিসঙ্গতাকে। অথচ তার চারপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড় আর সে যেন এক ঝাঁক কাকের কোলাহলে একটি নিভৃত কোকিল। আপন মনে গান গেয়ে যায়। কেউ শুনলেও তার গান চলে, কেউ না শুনলেও তার গান থামে না।