সম্পাদকীয়
নিজেকে একটু একটু করে নিংড়ে দেওয়ার নামই লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা। নিজেই নিজেকে মেরে ফেলা মন্তান্তরে গঠিত করার এমনতর প্রয়াস বোধকরি খুব বেশি পাওয়া যাবে না চারপাশে। ২০১৬ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল গল্পবিষয়ক লিটলম্যাগ প্রকাশ-এর ৮ম সংখ্যা। তারপর প্রায় ৯ বছরের দীর্ঘ বিরতি। বিরতিটুকু ইচ্ছাকৃত নয়--বলাই বাহুল্য। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকট যে একই সুতোয় গাঁথায়--সেসবেরই প্রভাব এই স্থবিরতা তথা বন্ধ্যা সময়ের আঁচড়-অভিঘাত।
নানা কারণেই সময়মতো লিটলম্যাগ প্রকাশ করা যায় না। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা অর্থনৈতিক। ভালো গদ্য না পাওয়াও অনাকাক্সিক্ষত বিলম্বের বড় কারণ। লেখকদের তাড়া দিয়ে বিষয়ভিত্তিক কোনো লেখা লেখানোর অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যায়, তারা লেখাটা অন্য কোনো পত্রিকায় দিয়ে দেন! সাহিত্যবিষয়ক অনলাইন, ওয়েব পোর্টালের ছড়াছড়ি এখন চারদিকে; এই মাধ্যমে কাগজ কেনার বালাই নেই, নেই মুদ্রণ ও বাইন্ডিংয়ের খরচও। কোনো কোনো লেখক তাৎক্ষণিক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সহজ পন্থার এসব পোর্টালের দ্বারস্থও হন। ‘অধৈর্য’ লেখকরা মনে রাখার চেষ্টা করেন না, কে তাদের নির্র্দিষ্ট বিষয় দিয়ে, প্রয়োজনীয় রসদ ও তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে, সর্বোপরি একধরনের চাপের মধ্যে রেখে লেখাটা শেষ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন!
আবার সম্মানী প্রত্যাশা করেন, আগ-পিছ না ভেবে চেয়েও বসেন--এমন লেখকও আছেন। লিটলম্যাগ হচ্ছে বরাবরই সম্মিলিত প্রয়াস। পাঠক লেখক শুভান্যুধায়ীদের সহযোগিতামূলক মনোভাবেই প্রকাশনা একটু একটু করে এগিয়ে যায়। আলোর মুখ দেখে। কিন্তু ‘রক্ষক যিনি, তিনিই যদি ‘ভক্ষক হয়ে উঠতে চান--এমন দীর্ঘ বিলম্ব ঘটাই স্বাভাবিক। কোনো কোনো লেখক এমনও আছেন অতীতে রাজা-উজির মারার গল্প শোনাতে পছন্দ করেন। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া আর টাকশালে টাকা ছিল। সেই টাকা ও থইথই সম্মান তাদের পায়ের কাছে লুটোপুটি খেতে আসত। অথচ এই গালগল্পবাজরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না বর্তমান রূঢ় বাস্তবতা। তাদের লেখা ধারণ করতে গিয়ে একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে কী পরিমাণ অমানুষিক-অমানবিক কসরতই না করতে হয়! হয়ে উঠতে হয় নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর।
প্রশ্ন উঠতে পারে--তাহলে কী দরকার এত গ্লানি সয়ে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করার?
যিনি দরকার মনে করবেন, তিনি পিছপা হবেন না, নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবেন--এটাই স্বাভাবিক। পরের জন্য কাষ্ঠ আহরণ করে যে নবকুমার, নিজের অনিবার্য বিপদ জেনেও ঠিকই রান্নাবান্নার উপকরণের জোগান দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাবেই। অপরের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করবেই।
এর আগে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন সংখ্যা প্রকাশ করার। কিন্তু পর্যাপ্ত ভালো লেখা না পাওয়ায় সেটা করা সম্ভব হয়নি। অল্পস্বল্প যেসব লেখা পেয়েছিলাম, সেগুলো স্বতন্ত্র সংখ্যা প্রকাশ করার মতো নয়। এই সংখ্যায় পত্রস্থ হলো একটা লেখা। লিখেছেন লাবণ্য প্রভা।
রতনতনু ঘোষ ছিলেন ‘প্রকাশ লিটলম্যাগের অন্যতম সুহৃদ। বিগত সংখ্যাগুলোতে তিনি লেখা ও পরামর্শ দিয়ে আমাদের পাশে ছিলেন। তার আচানক মৃত্যু সাহিত্যাঙ্গনের জন্য তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবে আমাদের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি। তাকে নিয়ে থাকছে একটা লেখা। এই লেখা দেখে পাঠক বিব্রত হতে পারেন হয়তো। কারণ আমরা প্রকাশ করি গল্পকেন্দ্রিক লেখাজোকাই। সেখানে এমন স্মরণ-স্মৃতিচারণমূলক লেখা বলতে গেলে অপ্রত্যাশিত। প্রয়াত লেখকের সম্মানার্থে আমরা এটা প্রকাশ করলাম।
চলতি সংখ্যা থেকে যুক্ত হলো নতুন ক্রোড়পত্র--বাংলাদেশের গল্প : জেলাভিত্তিক গল্পচর্চার ইতিহাস। অন্তত তিন থেকে চারটি সংখ্যায় আমরা তুলে আনতে চাই বাংলাদেশের গল্পচর্চার পটভূমি, ভিত্তিভূমি ও ইতিহাস-পরম্পরা। এই বিষয়ে বিস্তারিত ঘোষণা দেখুন ২৪-২৫তম পৃষ্ঠায়। গল্পবিষয়ক যে কোনো ধরনের বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন আপনিও। যদি লেখাজোকা প্রকাশের বিস্তর তাড়া না থাকে!
জীবন গল্পময়; গল্পের জয় হোক।
শফিক হাসান