শুকনো কাঠির মতো চেহারা। একটু কুঁজো, মাথায় কাঁচা পাকা চুল, হাটে তরি-তরকারি কিনে গ্রামের ঘরে ঘরে বেচে বেড়াতো। চোখ দুটো ছিলো নরুনে-চেরা চোখের মতো ছোটো। দৃষ্টি তীক্ষèই ছিলো, কিন্তু ডাইনি শুনে মনে হতো সে চোখ যেন আমার বুকের ভেতরে ঢুকে আমার হৃদপি-টা খুঁজে ফিরছে।
স্বর্ণ গ্রামে বড়ো কারোর ঘরে ঢুকতো না। আমার অনেক বয়স পর্যন্ত স্বর্ণ বেঁচে ছিলো। আমার স্বর্ণপিসি বলতাম। বেচারি গ্রামের ভদ্রপল্লী থেকে দূরেÑ জেলেপাড়ার মোড়ে একখানি ঘর বেঁধে বাস করতো। সে-পথে যেতে আসতে দেখেছি, বুড়ি ঘরের মধ্যে আধো-অন্ধকার আধো-আলো মধ্যে বসে আছে। কথা বড়ো কারো সঙ্গে বলতো না। কেউ বললেও তাড়াতাড়ি দু-একটা জবাব দিয়ে ঘরে ঢুকে যেতো। তার শেষ কালটায় আমি বুঝেছিলাম তার বেদনা। মর্মান্তিক বেদনা ছিলো তার। নিজেরও তার বিশ্বাস ছিলো, সে ডাইনি। কাউকে স্নেহ করে সে মনে মনে শিহরে উঠতো। কাউকে দেখে চোখে ভালো লাগলো; সে সভয়ে চোখ বন্ধ করতো। দুই ক্ষেত্রেই তার শঙ্কা হতো, সে বুঝি তাকে খেয়ে ফেলবে, হয়তো বা ফেলেছে, বিষাক্ত তীরের মতো তার লোভ গিয়ে ওদের দেহের মধ্যে বিঁধে গিয়েছে।
সমগ্র পৃথিবীতে তার আত্মীয় ছিলো না, স্বজন ছিলো না। রোগে যন্ত্রনায় দুঃখে সমগ্র জীবনটাই সে একা কাটিয়ে গেছে।
ডাইনি স্বর্ণ একাই ছিলো না, আরো ছিলো। কিন্তু স্বর্ণের মতো অপবাদ কারুর ছিলো না। সে এক বিস্ময়কর ঘটনা। আমার চোখের উপর ভাসছে। জীবনে ভুলতে পারবো না শৈশবের দেখা সে ছবি। ঘটনাটি বলিÑ
আমাদের বাড়িতে ছিলেন আমাদেরই গ্রামের এক ব্রাহ্মণ-কন্যা-রান্নার কাজ করতেন। আমি তাঁকে বলতাম ‘দাদার মা'। তাঁর ছোটো ছেলেটিও তাঁর সঙ্গে থাকতেন আমদেরই বাড়িতে। অবিনাশ-দাদার উপর ছেলেবেলায় আমার গভীর আসক্তি ছিলো। তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে আঁকড়ে থাকতাম, স্কুলে যাবার সময় তিনি বিপন্ন হতেন। তিনিও আমাকে গভীর স্নেহ করতেন। একদিন খবর পেলাম, অবিনাশ দাদাকে স্বর্ণ ডাইনি খেয়েছে।