সাদিয়ার সফলতা
সেতু, পিংকি আর সাদিয়া—তিনটি নাম, তিনটি হৃদয়ের বন্ধন, আর তিনটি স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। ওরা একে অপরের ছায়া হয়ে বেড়ে উঠছিল শহরের এক ছোট্ট স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণির ছোট্ট এক ক্লাসরুম যেন হয়ে উঠেছিল ওদের রাজ্য, যেখানে রাজত্ব করত ভালোবাসা, নির্ভরতা আর নির্মল হাসির খেলা।
স্কুলে প্রবেশের পর থেকেই কেউ কাউকে একা পায় না। প্রতিটি দিন শুরু হতো একসঙ্গে স্কুলে এসে, একই বেঞ্চে বসে, পড়া আদান-প্রদান করে আর টিফিনের সময় একসঙ্গে খেয়ে। শুধু বান্ধবী নয়, ওরা যেন একে অপরের আত্মার অংশ হয়ে উঠে।
একদিন সকালে সেতুর মুখটা কেমন যেন শুকনো লাগছিল। কারণটা খুব ছোট—সে সেদিন ভুলে টিফিন আনেনি। ভেবেছিল, হয়তো আজ টিফিনের সময় একা থাকতে হবে। কিন্তু ও জানত না তার বান্ধবীরা একা থাকতে দিবে না। পিংকি আর সাদিয়া তাকে খুঁজে টেনে নিয়ে গেল টিফিনের বেঞ্চে, হাসিমুখে ভাগ করে দিল নিজেদের খাবার। কেউ তখনও জানত না এই বন্ধুত্বে অদৃশ্য এক ফাটল দানা বাঁধছে, যা ভবিষ্যতের এক চরম অধ্যায়ের শুরু।
সেতু আর পিংকি দুজনেই খুব মেধাবী। পরীক্ষায় বরাবরই তারা প্রথম আর দ্বিতীয় হয়। সেতু হয়তো ভাগ্যের ছোঁয়ায় এক-দুই নম্বর বেশি পায়, কিন্তু পিংকির মেধা ওর চেয়ে একবিন্দুও কম নয়। শিক্ষকরা তাদের গর্ব করেন, সহপাঠীরা তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়। এমন প্রশংসায় অভ্যস্ত হতে হতে ওদের মনে জন্ম নেয় এক ধরনের আত্মবিশ্বাস, যেটা আর স্বাভাবিক থাকে না—বরং হয়ে ওঠে অতিরিক্ত।
একদিন স্কুলের হেডস্যার পিকুল সাহেব ক্লাসে এসে ঘোষণা করলেন, সেতু আর পিংকি এবার ক্লাস ক্যাপটেন। এটা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল ওরা। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিদিন ইতিবাচক রইল না। দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা বদলে যেতে লাগল। অহংকার আর গর্বের দেয়াল গড়ে উঠতে লাগল চারপাশে।
সাধারণ বন্ধুদের দিকে তাকানোই যেন অসম্মান মনে হতো। সহপাঠীদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার নাম করে শুরু করল অপমান আর অবজ্ঞা। এক সময়ের প্রিয় বান্ধবী সাদিয়া—যে তাদের সুখ-দুঃখের সাথী ছিল—তাকে দেখা শুরু করল কেবল 'কম যোগ্য' একজন হিসেবে। সামান্য কিছু হলেই ধমক দিত। কেউ প্রতিবাদ করত না, এমনকি সাদিয়াও না।
কিন্তু সাদিয়ার চুপ করে থাকা মানে দুর্বলতা নয়। বরং সে নিজেকে প্রশ্ন করল—আমি কি সত্যিই এতটাই কম যোগ্য? নাকি আমি আমার শক্তি এখনো আবিষ্কার করিনি? সে গভীর এক প্রতিজ্ঞা করল—এবার নিজেকে প্রমাণ করেই ছাড়ব।
আর মাত্র দুই মাস বাকি বার্ষিক পরীক্ষায়। যেখানে সেতু আর পিংকি নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছিল, ভাবছিল আগের মতোই সহজেই ভালো রেজাল্ট হবে—সেখানে সাদিয়া রাতদিন এক করে দিল পড়াশোনায়। ঘুম, খেলা, আড্ডা সবকিছু বাদ দিয়ে বই আর খাতার মাঝেই খুঁজে পেল তার নতুন পৃথিবী।
মাঝে মাঝে মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন—এত কষ্ট করিস কেন মা? সাদিয়া হেসে বলত—এবার না পারলে নিজেকেই ক্ষমা করতে পারব না।
পরীক্ষার আগের রাতে সে ঠিক সময়েই ঘুমিয়ে পড়ল। কারণ একদিনের নয়—সারা দুই মাসের পরিশ্রমের ফসল কাটবে আগামীকাল। সকালে উঠে কুয়াশার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাবার দোয়া আর মায়ের কপালে চুমু নিয়ে পৌঁছাল পরীক্ষা কেন্দ্রে।
প্রশ্নপত্র হাতে নিয়েই মনে হলো স্বপ্ন দেখছে। সব প্রশ্নই পরিচিত। চোখে জল এসে গেল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল। যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই লিখতে শুরু করল। প্রতিটি উত্তর ছিল একেকটি গল্প—যেখানে সে তার সাধনা ঢেলে দিয়েছে।
সবগুলো পরীক্ষাই ভালো হলো। এবার অপেক্ষা শুধুই ফলাফলের।
অবশেষে সেই দিন এলো।
স্কুলজুড়ে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ল খবর—সাদিয়া প্রথম হয়েছে।
কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না। শিক্ষকরা ছুটে এলেন অভিনন্দন জানাতে। হেডস্যার কাঁধে হাত রেখে বললেন—তুমি আমাদের গর্ব।
যারা একসময় তাকে পাত্তা দিত না, তারাই এবার ভিড় করল পাশে দাঁড়াতে।
সেতু আর পিংকি ছিল চুপ। মাথা নিচু, লজ্জায় মুখ থেকে কোনো শব্দই বের হচ্ছিল না।
সাদিয়া তাদের কাছে গিয়ে বলল,
বন্ধু হারানোর জন্য নয়, ফিরে পাওয়ার জন্য।
সেতু আর পিংকি চোখে জল নিয়ে বলল,
আমরা ভুল করেছি সাদিয়া, তুমি আমাদের চেয়ে সত্যিই বড়।
জ্ঞানার্জন
এই গল্প শুধু তিন বান্ধবীর নয়—এটা আত্মমর্যাদা, অধ্যবসায়, অহংকারের পতন আর ভালোবাসার শক্তির প্রতিচ্ছবি। শুধু ছোটদের জন্য নয়, বড়দের জন্যও এতে রয়েছে অনুপ্রেরণা।
কখনো কাউকে ছোট ভাবা ঠিক নয়। কারণ সময়ের স্রোতে, যে আজ পিছিয়ে—সেই হতে পারে আগামী দিনের আলো।