প্রকাশকের কথা
বর্তমানে আমরা এমন এক সময়ে এবং সমাজে বসবাস করছি যেখানে দ্বীনদার, বিশ্বাসী এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী হিসেবে সমাজের জন্য আরো অনেক কাজ করার অবকাশ রয়েছে। আমরা পরিবার-প্রতিবেশী, পাড়া-মহল্লায় পরস্পরের সুখেদুঃখে এগিয়ে আসতে পারি। আমাদের সন্তান এবং কিশোর-তরুণদের তারবিয়াত (দ্বীনী ও নৈতিক প্রশিক্ষণ) এর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি। শরীরচর্চা এবং সুস্থ খেলাধুলা এবং বিনোদনের আয়োজনের মাধ্যমে খারাপ চিন্তা ও অভ্যাস থেকে নিজেদের এবং তরুণ সমাজকে বিরত রাখতে পারি। সর্বোপরি, নিজেদের ব্যক্তিগত ময়দানে মুহাম্মাদ (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইতের প্রণীত নৈতিকতার চর্চার অবকাশ এখনো ষোল আনা’ই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে আমরা কতটাই বা অগ্রসর হতে পারলাম? রীতিসর্বস্বতা, দ্বন্দ্ব-বিতর্ক এবং জটিল-কঠিন আলোচনার বাইরে সহজ মানুষ হওয়ার প্রয়োজনীয় সফরে কতটুকুই বা আমরা অগ্রসর হলাম, এই প্রশ্ন কি প্রতিদিন নিজেকে করছি?
মানুষ একই সাথে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীব। বর্তমান সমাজের মানুষদের যে প্রবল হতাশা, রাগ, ভয় তথা বিভিন্ন ব্যক্তি মানবীয় মানসিক সমস্যা এবং বিকৃতি- এগুলোর সমাধানের জন্যে হরেক রকমের দাওয়াই, কাউন্সিলিং এবং মেডিটেশানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু তাতে কি আমরা এই মানুষগুলোকে বাঁচাতে সমর্থ হচ্ছি? না! অধিকাংশ সময় এসব অসুস্থতা এবং বিকৃতির সমাধান সম্ভব হচ্ছে না, এবং খুব কষ্টদায়ক পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। কেন এত প্রচেষ্টার পরেও সম্ভব হচ্ছে না? এর একটি বড় কারণ অবশ্যই এটা যে, ‘ব্যক্তির রোগের চিকিৎসা ব্যক্তিগত’- এ ধারণা সম্ভবত পুরোপুরিভাবে সঠিক নয়; বরং সঠিক হচ্ছে যে, ব্যক্তির অসুস্থতার সমাধান ও দাওয়াই কখনো ব্যক্তিগত, আবার কখনো সামাজিক ও পারিবারিক। সমাজ এগিয়ে না আসলে বা সমাজের সুস্থতা ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত অনেক রোগেরই সম্ভবত সমাধান সম্ভব নয়।
একটি সরল, সহজ, বাস্তবসম্মত কিন্তু একই সাথে বিপ্লবী স্মৃতিগ্রন্থ আপনাদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছি। এই বইয়ের কাজে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা এবং গুনাহরাজির কারণে অনেকবারই পিছিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু অবশেষে আমাদের হাত দিয়ে এই মহান ব্যক্তিত্ব- ইব্রাহিম হাদির স্মৃতিগ্রন্থটি প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন মহান আল্লাহ।
পাশ্চাত্যতাড়িত হলিউডি ফ্যান্টাসির বাইরে এসে একেবারেই বস্তুজগতের সত্যিকার, রক্ত-মাংসের একজন নায়কের স্মৃতিকথা আমরা অনুবাদ করে আপনাদের হাতে পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছি ইনশা আল্লাহ, যখন এরকম সুস্থ রোলমডেলের অভাবে আমরা বিকৃত তাগুতি হলিউডকে রোলমডেল হিসেবে গ্রহণ করছিলাম, যেগুলোর চরিত্রগুলোই আমাদের নিজেদের চরিত্রকে প্রভাবিত করে, কিংবা আরো খোলাসা করে বললে, আমাদের চরিত্রকে গড়ে দেয়। তাই আমরা যৌনতাড়িত, অপরিমিত, উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া বা অন্য কোনো বিকারসম্পন্ন চরিত্রদেরকে যখন রোলমডেল হিসেবে গ্রহণ করব, তখন আদতে তার স্বভাবকেই আমরা গ্রহণ করছি। তার স্বভাবের আছর পড়বে আমাদের উপরে। আর তা-ই হয়েছে! একত্ববাদের সাথে সাংঘর্ষিক মানবের সহজাত সুস্থ প্রবৃত্তিবিরোধী, ভোগবাদী, যৌনতাড়িত জীবনবোধ থেকে সৃষ্ট পাশ্চাত্যের কাল্পনিক বা ফ্যান্টাসি চরিত্র, কিংবা ঔপনিবেশিক বিভিন্ন ‘হিরো’ (পড়ুন- ভিলেন)-কে যখন আমাদের আইডল বা মূর্তি হিসেবে দাঁড় করাই, তখন সেই মূর্তিপূজা হতাশাবোধ আর হীনমন্যতার দিকে নিয়ে যায় স্বভাবতই। আর এভাবেই তো আমাদের তরুণেরা বিপ্লবী চেতনা হারাচ্ছে। পুরুষ তার পৌরুষ এবং নারী তার নারীত্ব হারাচ্ছে। এই আশংকাজনক ঘুণেধরা সমাজের হাওয়ার বিপরীতে আমাদের রুখে দাঁড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে প্রথম প্রচেষ্টা হলো এই অনুবাদকর্ম। এখানে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে আমাদের বসে থাকার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই বলেই মনে করি।
শহিদ ইব্রাহিম হাদির স্মৃতিকথা পাঠ করে আমাদের মনে অবশ্যই এই প্রশ্ন জাগবে যে, যদি ইব্রাহিম হাদির মতো ব্যক্তির স্বভাব-প্রভাব, আখলাক, মানবীয় মূর্তি এবং কারিশমা এতটা ব্যাপক হয়, তবে তাঁর শিক্ষক মুহাম্মাদ (সা.), মা ফাতেমা, আলী, হাসান, হুসাইন এবং আহলে বাইতের বাকি ইমামগণের স্বরূপ কতটাই না ব্যাপক এবং কতটাই না অবিশ্বাস্য!
এই বইয়ের অনুবাদে একেবারে নিঃস্বার্থভাবে যে তরুণ ভাইয়েরা কাজ করেছেন এবং সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব পালন করে আমাদের কাজকে সহজ করে দিয়েছেন, তাঁদের প্রতিদান কেবল আল্লাহর থেকেই। এই বইয়ের অনুবাদে যত ভুল-ভ্রান্তি, তার সব দায় আমি নিজ কাঁধে নিচ্ছি, এবং অবশ্যই বইটির সকল ভালোর অবদান অনুবাদকগণ এবং সম্পাদকের।
এই মহান বইটি আমরা উৎসর্গ করতে চাই, শহিদ ইব্রাহিম হাদির মতো সকল শহিদকে, যাঁরা বলদর্পী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং নিঃস্বার্থতার এতটাই চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছেন যে, তাঁরা নিজেদের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ রাখাকেই সমীচীন মনে করেননি। আরো উৎসর্গ করতে চাই সকল হারিয়ে যাওয়া মানুষকে যাদেরকে ঘুণেধরা নষ্ট সমাজ এবং আচারসর্বস্ব ধর্মব্যবস্থা পথ দেখিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। উৎসর্গ করতে চাই আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানদের প্রতি, যা আমরা করতে পারিনি, তারা যেন ইব্রাহিম হাদি-গণের পথ অনুসরণ করে সেগুলো করতে পারে, যেন তারা ইমাম মাহদীর (পুনঃ) আগমনের পথ সৃষ্টি করে ন্যায়ভিত্তিক-দয়ার্দ্র-নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়। উৎসর্গ করি, এই বইয়ের কাজ শেষ করতে যিনি সহায়তা করেছেন- ইমাম রেযা; যাঁর জন্মদিনের দিন (১১ই জিলকদ) আমরা প্রকাশকের কথা লেখার মাধ্যমে বইয়ের প্রাথমিক কাজ শেষ করছি, যাঁর অবদান চিন্তাতিত, যাঁর প্রচেষ্টাতেই ইরান পরিণত হয়েছে বিপ্লবের ভূমিতে, যাঁর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে আহলে বাইতপ্রেমীদের হেফাযতগাহ হয়েছে ইরান। জীবিতকালে যাঁর জামার আস্তিন এবং শাহাদাতের পর তাঁর মাজারের তাওয়াসসুলের মাধ্যমে সুস্থ হয় জামানার শ্রেষ্ঠ আলেমগণ এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ।
আর সবিশেষে, এই বইটি পৌঁছে দেয়ার প্রত্যাশা করি- আমাদের মা, শহিদ ইব্রাহিম হাদির ভালোবাসার চূড়ান্ততম আশ্রয়স্থল ফাতেমা যাহরা সালামুল্লাহ আলাইহার নিকট, যাঁর কবর আজ অবধি অজ্ঞাত থাকা ইতিহাসের চূড়ান্ততম এক নিদর্শন এবং প্রবলতম এক কুঠারাঘাত। আমাদের এই ক্ষুদ্র কর্মের হাদিয়া হিসেবে পাঠকের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনারা আমাদের এবং আপনাদের মরহুমদের রুহের মাগফিরাতের জন্য অন্তত একবার সূরা ফাতিহা, তিনবার সূরা ইখলাস এবং যথাসম্ভব অগণিতবার দরুদ পাঠ করবেন!
১১ ই জিলকদ, ১৪৪৬
১০ মে, ২০২৫
ঢাকা