সময় মানবসভ্যতা আজ এমন একটি সময় অতিক্রম করছে, যেখানে সংস্কৃতিকে করা হচ্ছে মুছে ফেলা। পৃথিবীব্যাপী সংঘটিত বিভিন্ন পরিবর্তন, শ্রান্তিহীন ভারসাম্যহীন অভিযাত্রাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ফিলিস্তিন গণহত্যা, রোহিঙ্গা-উইঘুর নির্যাতন, বাংলাদেশ-সিরিয়ার গণহত্যাচেষ্টা, বিচ্ছিন্নতাবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও ইহুদি-ইংরেজের যৌথ আগ্রাসন, ইহুদি দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিটি ঘটনাকে বৈধতার মর্যাদায় উপস্থাপন করার চেষ্টা, এককথায় বিশ্বকে শাসনের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা—সবই মানবতার বিরুদ্ধে এক কঠিন অপরাধ। পাশ্চাত্যের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব আর পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, শোষণ আর অস্ত্রের বাণিজ্য, মানবতাবিরোধী এক ভয়াবহ যুদ্ধপ্রয়াস।
সময় মানবতার অস্তিত্বকে তার আদর্শচ্যুত ভিত্তিতে পরিচালনার একপ্রকার সচেতন ইসলামী সচেতনতা। সময় মানবতার ঐ ঐশ্বর্য হারিয়ে আমাদের চোখের সামনে ভুলে যেতে দিচ্ছে, মানুষকে তার আসল দৃষ্টিতে দেখতে পারে না, যদি প্রাথমিক পর্যায়ে তার সামনে ইসলামী সচেতনতা ও ঐশ্বর্য ফিরিয়ে না আনা হয় এবং তা যথাযথ জ্ঞাননির্ভর আলোচনায় উপস্থাপিত না করা যায়।
ইসলামী চিন্তাবিদ ও স্কলার, বিশেষ করে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল-ই-উম্মাহ দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থান করছে। যুগপৎ চিন্তা ও গবেষণার সংকট নিরসনে আমাদের অবদান রাখতে হবে। চিন্তার ও শরীয়াহ অভিপ্রায়কে সামনে নিয়ে বাংলাদেশে ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে চিন্তাশীলদের মধ্যে একটি চিন্তার সূচনা হতে হবে। চিন্তাশীলদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সত্যকে চিনে নেওয়া এবং সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরবিচারে ও সাহসিকতার সঙ্গে একটি প্রজন্মের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগানো। এ চিন্তা তৈরির মাধ্যমে, বাংলাদেশ শিক্ষিত সমাজের মধ্যে একটি চিন্তার পদ্ধতি চালিয়ে যাচ্ছে—❝বিকল্পবিশ্ব❞।
ছাত্রদের পাঠাভ্যাসের এক ধরনের ভিত্তিকে সামনে রেখে একাদশ শ্রেণির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বিকল্পবিশ্বের ছায়াপত্র, পাঠ্যপুস্তকের এক ধরনের বিকল্প চিন্তা, সচেতনতা তৈরির একটি পথিকৃত—যা বিশাল তথ্য ও যুক্তিতর্ক সামনে রেখে নতুন প্রজন্মের চিন্তাশীল সমাজের জন্য একটি আশার সূচনা করতে পারবে। এ ধারাবাহিক চিন্তাশীল সমাজের সচেতন পাঠকের অন্তরস্থ, সাহসিকতাপূর্ণ বিশ্বাসঘন অনুধ্যানভিত্তিক গবেষণাধর্মী সমাজগঠনের চিন্তা থেকে বেরিয়ে নিলে, চিন্তা আমাদের জন্য স্বাধীন ও অন্তর্নিহিত শক্তির পথ খুলে। উপস্থাপিত বিষয়সমূহকে যাচাই-বাছাই করে পাঠকের সামনে যেন এক অনন্য বিকল্প পাঠচিন্তা ও চিন্তাশীলতার এক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করতে পারে এবং এতে একটি প্রজন্মের ভিত গড়ে উঠে। পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাসিজম সরে গেলে মানবদৃষ্টি ফ্যাসিজম সরাবে না, চিন্তার ফ্যাসিজম সরাবে।
দৃশ্যমান উপনিবেশবাদ না থাকলেও মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশবাদ এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। এজন্য অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়, ব্রিটিশ একাডেমিয়ার জ্ঞানতাত্ত্বিক অগ্রাসন ও দুনিয়ার অবস্থাকে সামনে রেখে নতুনভাবে আনের আলাপ হাজির করা, যুবসমাজকে উজ্জীবিত করা ও দেশ বিনির্মাণের অর্থপূর্ণ সংগ্রামে নিয়োজিত হওয়া সময়ের দাবি।
এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই ত্রৈমাসিক মিহওয়ারের এবারের সংখ্যা সাজানো হয়েছে। বরাবরের ন্যায় উম্মতের আলেম ও দার্শনিকবৃন্দের চিন্তা এবং তরুণ সমাজের ভাবনা একই সুতোয় গাঁথার প্রচেষ্টা ছিলো আমাদের। ৬ষ্ঠ সংখ্যা থেকে আমরা মিহওয়ারের প্রবন্ধ নির্বাচন ও বিভাগের ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছি। ৮ম সংখ্যাও সেভাবেই সাজানো হয়েছে।
এ সংখ্যায় মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকছে বহুভাষী দার্শনিক ও সভ্যতাবিশারদ আলেম প্রফেসর ড. তাহসিন পরগুনের গবেষণা প্রবন্ধ ইসলামে সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সুন্নত। প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট অনুবাদক এবং জ্ঞান ও সভ্যতা বিষয়ক গবেষক বুরহান উদ্দিন আজাদ। এ প্রবন্ধটি মূলত ওরিয়েন্টালিস্ট এবং পশ্চিমা প্রভাবিত এক শ্রেণির ইসলামপন্থীদের একটি খণ্ডিত বয়ানের জবাবও। একালে অনেকেই অঞ্চলভেদে ইসলামের যে বৈচিত্র্য সেটিকে সে অঞ্চলের ইসলাম বা আঞ্চলিক ইসলামের রূপ দিতে চান। সে জায়গা থেকে ভারতীয় ইসলাম-আরবীয় ইসলাম-পাকিস্তানি ইসলামের আলাপ আসে। আবার 'Many Islams' বলা হয়। বাস্তবতা হলো ইসলামের এ অসাধারণ বৈচিত্র্য এবং এ বৈচিত্র্যের মাঝেও একত্বের কারণ হলো সুন্নত। পয়গম্বর (স.)-এর সুন্নতই সবচেয়ে বড় কারণ, যা মুসলমানদের মাঝে এ বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রেখেছে এবং ভিন্নতার মাকেও একত্ব ধরে রেখেছে। এ বিষয়গুলোর দার্শনিক বিশ্লেষণ হাজির করেছেন প্রফেসর ড. তাহসিন পরগুন।
মুসলিম চিন্তাধারা বিভাগে থাকছে ইমাম মাতুরিদি ও তাঁর চিন্তাধারা শীর্ষক প্রবন্ধ। প্রবন্ধটি সংকলন করেছেন মিহওয়ারের সহ-সম্পাদক মিফতাহুর রহমান। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রবন্ধে ইমাম মাতুরিদির জীবন ও তাঁর চিন্তাদর্শনের একটি সারচিত্র ফুটে উঠেছে
ইসলামী জ্ঞানে উসুল বিভাগে থাকছে আঙুল আল ফার্সী উসূলের নবায়নে তাঁর চিন্তাদর্শন শীর্ষক প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধের রচয়িতা উম্মতের মহান আলেম, উসূলবিদ, মুহাদ্দিস ও মুতাফাক্সির প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ। প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আবু বারিরা। মরক্কোর উসলবিদ আলেম ও রাজনীতিক আল্লাল আল ফাসীকে নিয়ে বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম কাজ। গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটিতে আল্লাল আল ফার্সীর দর্শন ও উসূল সংক্রান্ত বিশিষ্ট চিন্তা ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে।
প্রফেসর ড. মুতাজ আল খতিব একালের বিশিষ্ট মুতাফাক্কির ও আখলাক বিশেষজ্ঞ। দ্বীন, আখলাক ও জেনেটিক হস্তক্ষেপ নিয়ে তাঁর জরুরী গবেষণাকর্ম 'জন ও আখলাক। জেনেটিক হস্তক্ষেপের প্রেক্ষিতে ইসলামে আখলাকের ধারণা'। শুরুত্বপূর্ণ এ প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন
তরুণ অনুবাদক ও চিন্তক মুশফিকুর রহমান। প্রাঞ্জল অনুবাদে দ্বীন ও আখলাকের ক্ষেত্রে আমাদের বোঝাপড়ার জায়গাটা কেমন হওয়া উচিত তা ফুটে উঠেছে।
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে গণঅভু্যত্থান স্থায়ীকরণের পন্থা ও ভবিষ্যত বাংলাদেশ শীর্ষক পর্যালোচনা করেছেন মিহওয়ার সম্পাদক হাসান আল ফিরদাউস। গণঅভ্যুত্থানের এক বছরে নাগরিক প্রত্যাশার প্রতিফলন কতটা হয়েছে, এ অভ্যুত্থানের প্রেরণাকে কীভাবে স্থায়ী করা যায় এবং একটি স্থিতিশীল ও শক্তিশালী দেশ নির্মাণের কার্যকারণগুলো কী কী তা নিয়ে তিনি আলাপ তুলে ধরেছেন।
বাংলা অঞ্চলে সুলতানী আমলে শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিলো, আলেমগণ কীভাবে দরস দিতেন, শিক্ষাধারা কেমন ছিলো এবং আমাদের সোনালী যুগে শিক্ষাব্যবস্থার একটি স্বরূপ বাংলা অঞ্চলের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও গবেষক প্রফেসর ড. আব্দুল করিম তুলে ধরেছেন তাঁর একটি দীর্ঘ নিবন্ধে। সে নিবন্ধটি সংক্ষিপ্ত ও প্রাঞ্জল আকারে সংকলন করেছেন তরুণ চিন্তক সাব্বির হাসান সিফাত। আমরা আশাবাদী, এ বিষয়ে এ প্রবন্ধটি পাঠকদের গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি দিবে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ডি-৮ বিভাগে থাকছে তরুণ চিন্তক ও গবেষক হিশাম আল নোমানের তুফান আল আকসা, হামাস ও ফিলিস্তিন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন সমীকরণ শীর্ষক প্রবন্ধের শেষ পর্ব। দুই পর্বের এ লেখাটি বাংলা ভাষায় তুফান আল আকসা ও ফিলিস্তিন নিয়ে পাঠকদের জন্য সবচেয়ে গোছালো কাজ।
বই পর্যালোচনায় থাকছে প্রখ্যাত আলেম, মুতাফাক্কির ও মাকাসিদ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ৬. জাসের আওদার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রি-ইনভিশনিং ইসলামিক স্কলারশিপ মাকাসিদ মেথডোলজি এজ আ নিউ এঙ্কোচ নিয়ে আলাপ। পর্যালোচনা করেছেন মিহওয়ারের সহ। সম্পাদক সা'দ মুসান্না।
পরিশেষে, মিহওয়ারের সাজসজ্জা থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয় নিয়ে যেকোনো সমালোচনা, পর্যালোচনা ও পরামর্শকে স্বাগত জানাই। বরাবরের ন্যায় এবারও সময়ের সেরা চিন্তাবিদগণ ও তরুণ চিন্তকদের লেখনীর মেলবন্ধনের মাধ্যমে ইতিহাস ও নতুনত্বের ছোঁয়ায় উপস্থাপিত হবে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ মিহওয়ার এর ৮ম সংখ্যা। মহান রবের নিকট আমাদের চাওয়া, জ্ঞানের পুনর্জাগরণ এবং ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানকে উপজীব্য করে নতুন ধারা তৈরির এই মহান আন্দোলনে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাটুকু যেন সামান্যতম হলেও অবদান রাখতে পারে।