এক
বাংলাদেশের আধুনিক চারুকলা চর্চার বয়স ৭৬ বছর, তার মধ্যে
স্বাধীনতা-পূর্বকালের ২৩ বছর এবং স্বাধীনতা-উত্তর ৫৩ বছর। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরের মধ্যেই ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রথম চারুকলা
ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আধুনিক চিত্রকলার যাত্রা শুরু হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬), তখন এক তরুণ খ্যাতিমান শিল্পী।
ধর্মভিত্তিক নব্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজে একটি চারুকলা
ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা ছিল রীতিমতো বিপ্লবাত্মক ঘটনা। জয়নুল আবেদিন ও তাঁর সহযোগীদের অদম্য উৎসাহ তারে স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব করেছিল। চারুকলা
ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই আবার কামরুল হাসানের উদ্যোগে ও জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সরকারি পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সমান্তরাল এক
আন্দোলন শুরু হয় ঢাকা আর্ট গ্রুপ নামে সংগঠনের মাধ্যমে। এতে তাঁরা সম্পৃক্ত করেন ঢাকার বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক তথা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের। এর শুরু ১৯৪৯ সালে। সরকারিভাবে চারুকলার শিক্ষা কার্যক্রম ও বেসরকারিভাবে শিল্প গোষ্ঠী
সংগঠন এরকম যুগপৎ যাত্রার মধ্য দিয়ে বস্তুত চারুকলা চর্চা একটি সাংস্কৃতিক
আন্দোলন হিসেবেই অগ্রসর হতে থাকে। ব্যাপারটিই অভূতপূর্ব।
বাংলাদেশের চিত্রকলা পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্বে এসেই আধুনিক আঙ্গিক পেতে থাকে, অর্থাৎ বাস্তববাদী বা রূপান্তরধর্মী আঙ্গিক থেকে মানব অবয়বের
স্টাইলাইজড উপস্থাপনা ও নিসর্গদৃশ্যের সহজীকৃত রূপায়ণ কিংবা লোকজ শিল্প ফর্মের সঙ্গে আধুনিক আঙ্গিকের সংমিশ্রণ, এ-ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কাজ এ-সময়ের মধ্যেই দেখা গেছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশের চারুশিল্পের মাধ্যম বৈশিষ্ট্যে দেখা গেছে চিত্রকলা বা পেইন্টিং ও ছাপাই চিত্রের পাশাপাশি ভাস্কর্যের চর্চা শুরু হতে। পাকিস্তান পর্বে চিত্রশিল্পের বিষয় বা বক্তব্য ছিল প্রধানত অরাজনৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। এমনকি ভাষা-আন্দোলনের শৈল্পিক প্রতিক্রিয়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বাইরে খুব একটা দেখা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবীণ শিল্পী কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮) ‘এই সব
জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শিরোনামের অসাধারণ পোস্টার করেছেন, অন্যান্য তরুণ শিল্পীও শিল্পকর্মে ব্যাপৃত থেকেছেন। স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন সময়ে প্রবীণ ও নবীন শিল্পীদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ছবি এঁকেছেন।
স্বাধীনতা-উত্তর সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা শিল্পীদের অনেককেই বক্তব্য প্রধান শিল্পী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সামাজিক অস্থিরতা, নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের অনৈতিকতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি এসব ছিল তরুণদের কাজের বিষয়বস্তু। উপস্থাপনার ভঙ্গি বা আঙ্গিক নতুন। নানাভাবে মানব-অবয়ব বিকৃত করে দেখানো হয়েছে। পরাবাস্তব উপস্থাপনা, রং ব্যবহারও উচ্চকিত ও অস্বাভাবিক। ব্যঙ্গাত্মক ও কার্টুনধর্মী ছবিও পরিপূর্ণ পেইন্টিং। মূলত উত্তর-আধুনিক চেতনা কাজ করেছে এসব শিল্পীর কাজে।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে সমাজে নারীর অবস্থান বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে, অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলা শিল্পীদের হাতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীনতা-পরবর্তী শিল্পচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি বেশ বড় সংখ্যায় মহিলা শিল্পীদের উত্থান। এদের অনেকেই নিশ্চিতভাবে আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী। স্বাধীনতা বাংলাদেশের নারী সমাজকে
নিঃসন্দেহে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, এ-কথা চিত্রশিল্পীদের বেলায় বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এদের কারো কারো কাজে নারীবাদের স্পষ্ট ঈঙ্গিত রয়েছে। শিল্প আঙ্গিকের দিকে থেকে তাঁরা আধুনিক ও উত্তর আধুনিক প্রবণতা বিশিষ্ট।
স্বাধীনতা-উত্তর চিত্রকলা পূর্বেকার বিমূর্ত ধারাকে যেমন অনুসরণ করেছে, পাশাপাশি আধা-বিমূর্ত ধারা বা অবয়বধর্মী আঙ্গিক, পরাবাস্তববাদী আঙ্গিক ও উত্তর-আধুনিক আঙ্গিক, অর্থাৎ যেখানে তেমন কোনো ধরাবাঁধা প্রথাগত নিয়ম মানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করা হয় না, সেসব নতুন আঙ্গিক গুরুত্ব পাচ্ছে। শিল্পকলায় সব সময়েই অভিনবত্বের গুরুত্ব থাকে, তবে শিল্পের আবার দর্শক যোগাযোগও প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সময়ে শিল্পকলায় ক্যানভাস মাধ্যমকে আগের মতো গুরুত্ব দেওয়া হয় না, বরং নানা রকমের ‘স্থাপনা’ বা ‘ইনস্টলেশন’ কিংবা ‘নির্মাণ’ বা ‘কনস্ট্রাকশন’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাছাড়া মিশ্রমাধ্যমকেও যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হচ্ছে। সমকালীন শিল্পকলায়
পারফরম্যান্স আর্টেরও প্রচলন হয়েছে, নিউ মিডিয়া আর্ট, ডিজিটাল প্রযুক্তির
ব্যবহারও জনপ্রিয় হচ্ছে। মাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্য, মৃৎশিল্প ও সিরামিক শিল্প, কারুশল্প, গ্রাফিক্স ডিজাইন, নব্য মাধ্যম বা নিউ মিডিয়া, আলোকচিত্র ইত্যাদি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। তরুণ শিল্পীরাই এসব মাধ্যমে বেশি উৎসাহী।
স্বাধীন বাংলাদেশের সামগ্রিক শিল্প চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। উচ্চতর পর্যায়ে শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, শিল্পীর সংখ্যা বেড়েছে, পৃষ্ঠপোষকতার মাত্রা বেড়েছে, গ্যালারি ও শিল্পাঙ্গনের সংখ্যা বেড়েছে, প্রদর্শনীর সংখ্যা বেড়েছে, শিল্পবিষয়ক প্রকাশনার ধরন ও মান বেড়েছে। শিল্পে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বেড়েছে এবং শিল্পকর্মের চাহিদা ও আথির্ক মূল্যও বেড়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতা শিল্পকলার
বহুমুখী বিকাশের বিশাল সুযোগ করে দিয়েছে। ১৯৪৮ সালে জয়নুল আবেদিনের হাতে যে বৃক্ষের চারা রোপণ হয়েছিল আজ ৭৬ বছরে এসে সেটিকে মহীরুহ বলেই মনে হয়।
দুই
আমি বাংলাদেশের শিল্প ও শিল্পী নিয়ে লিখেছি বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে। ইতোমধ্যে এ-বিষয়ে বেশ কয়েকটি মনোগ্রাফ ও প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
আমার বর্তমান প্রবন্ধ সংকলনটির বিশেষত্ব, প্রবন্ধগুলো সবই আবুল
হাসনাত-সম্পাদিত বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের মাসিক সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম ও ত্রৈমাসিক/ ষান্মাসিক শিল্প ও শিল্পী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েকটি প্রবন্ধ আবুল হাসনাত-সম্পাদিত ও বেঙ্গল পাবলিকেশন্স-প্রকাশিত বিভিন্ন স্মারক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল।
বর্তমান সংকলনে মোট ২০টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। একটি প্রবন্ধ স্থপতি
মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে, দ্বিতীয়টি শিল্প সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতি বোদ্ধা অধ্যাপক
আনিসুজ্জামানকে নিয়ে ও তৃতীয় প্রবন্ধটি ধীমান সম্পাদক আবুল হাসনাতকে নিয়ে রচিত হয়েছিল। বাকি সব প্রবন্ধ বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পী ও শিল্পকলা নিয়ে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রবন্ধ ইংরেজি ভাষায় রচিত। প্রবন্ধসমূহের প্রকাশকাল ২০০৭ থেকে ২০২১। বইয়ে ব্যবহৃত চিত্রকর্মের তথ্যসূত্র ২২৩ পৃষ্ঠায় সংযোজিত।
সংকলনটি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড-এর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
- নজরুল ইসলাম