রবিন হুডের কাহিনি শুধু একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি নয়, বলা যেতে পারে মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন। একটি চরিত্রের নাম দেশ-কালের সীমা পেরিয়ে বাগ্ধারায় পরিণত হয়েছে— সারা পৃথিবীতে এমন উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া যায় না। এই একুশ শতকের দুনিয়াতেও রবিন হুডের গল্প শোনেননি বা পড়েননি— এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াও প্রায় অসম্ভব। ধনী ও ক্ষমতাবানদের হাত থেকে ছিনিয়ে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার এই আপাত-সরলরৈখিক ভাষ্য মধ্যযুগীয় গীতিকাব্যগুলির দিন পেরিয়ে আধুনিক উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও বারবার ফিরে এসেছে। আর প্রায় প্রতিবারই রবিন হুড হয়ে উঠেছে সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক একজন নায়ক। সে ন্যায়ের প্রতীক, দুর্বলের সহায়, অত্যাচারীর ত্রাস। যদিও দরিদ্রমাত্রই সৎ আর ধনীমাত্রই অত্যাচারী— এ-ও অতি অদ্ভুত সরলীকরণ!
আলেকজান্ডার দ্যুমার রবিন হুড এখানে স্বতন্ত্র। সেটি শুধু প্রচলিত লোককাহিনির পুনর্কথন নয়, তা দ্বাদশ শতাব্দের ইংল্যান্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার এক জীবন্ত প্রতিফলন। বহুচর্চিত সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণ হিসেবে প্রথমেই যা নজরে পড়ে, তা হল পঞ্চম শতাব্দের প্রথমদিকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটেনে থিতু হওয়া জার্মান উপজাতি বা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডি হয়ে ইংল্যান্ড দখলকারী ভাইকিং-বংশীয় নরম্যানদের বিরোধ।
দ্যুমার রবিন হুডের কাহিনি শুধু রিচার্ড-দ্য-লায়নহার্ট বা ‘সিংহহৃদয় রিচার্ড’-এর রাজত্বকালেই সীমাবদ্ধ নয়। গল্পের শুরুতে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে রাজা দ্বিতীয় হেনরিকে দেখা যায়। এরপর পর্যায়ক্রমে রাজা রিচার্ড ও রাজা জন হয়ে রাজা তৃতীয় হেনরির রাজত্বকালে কাহিনির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সোনার তার আর রেশমের সুতো দিয়ে বোনা বেনারসি শাড়ির মতোই এই দীর্ঘ সময়ের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে কল্পনার ভারসাম্যপূর্ণ সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার শব্দের সুদীর্ঘ এই উপন্যাস। বলা যায়, ঐতিহাসিক বিশ্বাসযোগ্যতার কারণেও এই কাহিনি পাঠকের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে আরও বেশি সফল। দ্যুমার চরিত্রচিত্রণ জটিল ও গভীরতর। তাঁর রবিন হুড শুধু একজন সাহসী আর দয়ালু ডাকাত নয়; সে যথেষ্ট চিন্তাশীল, রাজনীতি-সচেতন মানুষ। তার লড়াইও নিছক প্রতিশোধ আর লুণ্ঠিত অর্থে বিলিবণ্টনের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। রাজায়-রাজায় যুদ্ধে উলুখাগড়াদের জীবন তো বটেই, এই উপন্যাসে ধরা পড়েছে সমাজের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা থেকে আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ঘটনা-পরম্পরাও।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দ্যুমা কেন এমন করলেন? তিনি ছিলেন ‘রোমান্টিক অ্যাকশন হিরো’ তৈরির জাদুকর। তাঁর প্রায় সমস্ত উপন্যাসের নায়কই দারতানিয়ান (The Three Musketeers), এডমন্ড দান্তেসের মতো অভিজাত, দুঃসাহসী, প্রেমিক ও ‘larger-than-life’! রবিন হুডকেও তিনি গড়েছেন এক রোমান্টিক, করুণ অথচ সাহসী অভিজাত বিদ্রোহী হিসেবে। সে শুধু গরিবদের মধ্যে ধনসম্পদ বিলিয়ে বেড়ায় না, তার কিছু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি রয়েছে, রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিশোধের আগুন, আর সেইসঙ্গে তীব্র নৈতিকতাবোধ— সবমিলিয়ে একধরনের অভিজাত মানসিকতারই প্রতিফলন।
দ্যুমার নাট্যজগতের অভিজ্ঞতা এই কাহিনিতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দুই পর্বে বিন্যস্ত উপন্যাসটি যেন একটির পর একটি সুচিন্তিত মঞ্চদৃশ্যের মতো সাজানো, যেখানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নাটকীয় উত্তেজনা ও আবেগঘন মুহূর্ত গড়ে তোলা হয়েছে। দ্রুতগতির কাহিনিবিন্যাস, টানটান উত্তেজনা, সংলাপনির্ভর দৃশ্য ও অসংখ্য অভিনব পর্বান্তর (cliffhangers) পাঠকের আবেগ ও কৌতূহলকে প্রতিনিয়ত জাগিয়ে রাখে। ঊনবিংশ শতাব্দে দীর্ঘ রচনাগুলির প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি রেখে যাওয়ার যে চল শুরু হয়েছিল, এই উপন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। এর পাশাপাশি প্রেম, বিচ্ছেদ, পুনর্মিলন, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধ, রাজদরবারের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি একাধিক উপ-কাহিনির উপস্থিতি উপন্যাসটিকে শুধু কিশোর বা রোমাঞ্চপ্রেমী পাঠকমহলের কাছেই নয়, প্রাপ্তমনস্ক ও চিন্তাশীল পাঠকদেরও উপযোগী করে তুলেছে। শেরউডের জঙ্গল থেকে শুরু করে নটিংহ্যামের দুর্গ বা রাজপ্রাসাদ— দ্যুমা যেভাবে স্থান ও পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন, তা একমাত্র নাটক বা চলচিত্রের সঙ্গেই তুলনীয়। তাঁর বর্ণনার প্রাণময়তা কাহিনির আবেগের পাশাপাশি পাঠের অভিজ্ঞতাকেও দৃশ্যময়তা ও গভীরতা দান করেছে।
দ্যুমার কলমে দস্যুসম্রাট— অন্তরীপ পাঠকের দরবারে সগর্বে ও সহর্ষে উপস্থিত করেছে এই মহাকাব্যিক উপন্যাস। আধার ও আধেয়-র এমন নিখুঁত যুগলবন্দি, লেখনশৈলী ও চরিত্রের এমন অলৌকিক মেলবন্ধন সাহিত্যের ইতিহাসে কমই হয়েছে।