সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু সম্পাদিত সুকুমার রায়ের ‘সমগ্র শিশুসাহিত্য’ গ্রন্থে সত্যজিৎ রায়ের লেখা ভূমিকা
::
আমার বাবার যখন মৃত্যু হয় তখন আমার বয়স আড়াই বছর। সুতরাং আত্মীয়তাসূত্রে একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজনের যে পরিচয় হয়, আমার সঙ্গে আমার বাবার সেরকম পরিচয় হবার কোনো সুযোগ হয় নি। আমি তাকে চিনেছি তাঁর লেখা ও আঁকার মধ্য দিয়ে। তাঁর একটি খসড়া খাতা, কয়েকটি নোট বুক, একটা হাতে-লেখা পত্রিকার দুটি সংখ্যা, এবং আমার মা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মুখে শোনা বর্ণনার মধ্য দিয়ে।
সুকুমার রায়ের জন্ম হয় ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে। তাঁর মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক স্বাধীনচেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। পিতা ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়, যার বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় তাঁর লেখা গানে ছবিতে আর মুদ্রণের কাজে ছড়িয়ে আছে। বিজ্ঞান ও শিল্পের, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল উপেন্দ্রকিশোরের মধ্যে। বেহালার পাশে পাশে পাখোয়াজ বাজিয়েছেন তিনি, ব্রহ্মসংগীত রচনার সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণের কাজে মৌলিক গবেষণা চালিয়েছেন, রাত্রে বাড়ির ছাদে
বসে দূরবীন চোখে দিয়ে আকাশের তারা দেখেছেন, অননকুরণীয় সুষমামণ্ডিত সহজ ভাষায় পৌরণিক কাহিনী
ও গ্রাম্য উপকথা নতুন করে লিখেছেন ছোটদের জন্য, আর সেই সঙ্গে খাস বিলিতি কায়দায় তেল-রঙ জল-রঙ ও কালি-কলমে ছবি এঁকেছেন। ইলাসট্রেটর হিসেবে উপেন্দ্রকিশোরের কাজে যে দক্ষতা ও রীতিবৈচিত্র্য দেখা যায় তার তুলনা ভারতবর্ষে নেই।
এহেন পিতার সস্নেহ সান্নিধ্যে মানুষ হয়েছিলেন সুকুমার। তাঁর আরও দুটি ভাই ও তিনটি বোন ছিল, বয়সে সবচেয়ে বড় ছিলেন সুখলতা। তার পরেই সুকুমার। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস থেকে এই দুই ভাইবোনের ডাকনাম রাখা হয়েছিল তাতা ও হাসি।
সুকুমারের স্কুল ও কলেজের শিক্ষা হয় কলকাতাতেই। শিবনাথ শাস্ত্রী-প্রতিষ্ঠিত মুকুল পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি বাল্যরচনা ছাড়া ছাত্রাবস্থায় সুকুমারের সাহিত্য-রচনার কোনো নজির পাওয়া যায় না।
উপেন্দ্ৰকিশোর রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ সুকুমারের জন্ম ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০৬-এ পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন দুই বিষয়েই অনার্স নিয়ে বি.এসসি পাশ করার পর ১৯১১-য় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুপ্ৰসন্ন ঘোষ বৃত্তি লাভ করে মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি বিলেতে যান। লন্ডনে ও ম্যাঞ্চেস্টারে অধ্যয়ন করেন তিনি ও তাঁর গবেষণার জন্য সম্মানিত হন। ১৯১৩-য় উপেন্দ্ৰকিশোরের সম্পাদনায় ছোটদের সচিত্ৰ মাসিক পত্রিকা সন্দেশ’’ প্রকাশিত হয়। সুকুমার দেশে ফেরারী কিছুকাল পরে ১৯১৫-য় উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। সুকুমার ইউ রায় অ্যান্ড সন্স কার্যালয়ের পরিচালনার এবং “সন্দেশ’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্ৰহণ করেন। “সন্দেশ’-এর পাতাতেই তাঁর অধিকাংশ ছোটদের লেখা-গল্প, কবিতা, প্ৰবন্ধ, ধাঁধা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। শুধু নিজের লেখা নয়, ছবি এঁকেছেন তিনি। “হ য ব র ল’, ‘আবোল তাবোল’ জাতীয় আজগুবি চালের বেঠিক বেতাল ভুলের ভবের গদ্য ও পদ্য রচনা ছাড়াও শিল্প সাহিত্য ভাষা ধর্ম বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সক্রিয় ছিল তাঁর লেখনী। আড়াই বছর কালাজ্বরে ভুগে ১৯২৩-এ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সুকুমার রায় ১০০ গড়পার রোডের বাড়িতে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি শুয়ে শুয়ে সন্দেশের জন্য ছবি এঁকেছেন, প্রচ্ছদ রচনা করেছেন, গল্প কবিতা লিখেছেন। আবোল তাবোল’-এর ডামি কপিাটাও রোগশয্যায় তৈরি করেছেন। কিন্তু বইটি ছেপে বেরোবার ন” দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়।