একটি বইয়ের কার্যকারিতা অনেকটা একজন মানুষের মতো—তার বিষয়বস্তুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই তার শক্তির প্রধান উৎস। একটি বই ভালো চিন্তা ও সুন্দর উপস্থাপনায় পরিপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু লেখক যদি ভুল কোণ থেকে বিষয়টি দেখেন, তবে তাঁর উৎকৃষ্ট পরামর্শও অকার্যকর হয়ে উঠতে পারে।
এই বইটি তার লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির উপর দাঁড়িয়ে আছে। যদি জনসমক্ষে কথা বলার সেরা উপায় হয়—মনকে নিয়মে ভরিয়ে তোলা, নির্দিষ্ট মানদণ্ডে চিন্তা, ভাষা, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদিকে আবদ্ধ করা—তবে এই বই কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু উপকারি ধারণা হিসেবে মূল্যবান হতে পারে। তবে এমন কোনো নিয়মভিত্তিক বই হিসেবে এর প্রচেষ্টা ব্যর্থ বলেই গণ্য হবে, কারণ সেটি হবে একেবারে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি।
সুতরাং, এই বই পাঠের শুরুতেই পাঠকের বোঝা উচিত এর ভিত্তি ও নির্মাণের মূল ভাবনা কী। সরল ভাষায় বলা যায়:
জনসমক্ষে কথা বলা কোনো বাহ্যিক বিষয় নয়; এটি কোনো অনুকরণ বা নির্দিষ্ট রীতির অনুসরণ নয়। এটি হলো ব্যক্তিসত্তার প্রকাশ। তাই সবচেয়ে জরুরি হলো, সেই ব্যক্তি যেন এমন কিছু চিন্তা করেন, অনুভব করেন এবং বিশ্বাস করেন, যা জনসমক্ষে বলা যোগ্য।
যদি ভিতরে কিছু না থাকে, তবে হাজারো প্রশিক্ষণও তাকে শুধু একটি যন্ত্রে পরিণত করবে—অন্যের কথা বলার জন্য নিখুঁতভাবে গড়া একটি যন্ত্রমাত্র। এজন্য আত্ম-উন্নয়নই আমাদের মূলনীতি।
দ্বিতীয় নীতি: মানুষকে নিজের চিন্তা, অনুভব, ও শারীরিক ক্ষমতার উপর নিজের ইচ্ছাশক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেন তাঁর বাইরের প্রকাশ অন্তরের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া প্রতিফলিত হয়। কণ্ঠস্বর, স্বরভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি নিয়ে নিয়ম শেখানো তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন এই দুটি মূল নীতির প্রভাব ব্যক্তি জীবনে অনুভূত হতে শুরু করবে।
তৃতীয় নীতি: কেউ কথা বলা শিখবে না যতক্ষণ না সে চেষ্টা করে নিজে বলার। এটি এক ধরনের পরস্পর নির্ভর সম্পর্ক—কিন্তু সত্য। অভিজ্ঞতাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, এবং সেই অভিজ্ঞতারই শুরু ও শেষ—চর্চা।
প্রথমে নিজে কথা বলা শিখতে হবে—তারপর কণ্ঠ, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা। নিজের ভুল বোঝার জন্য তিনটি বিষয় জানতে হবে:
- জনসমক্ষে কার্যকর বক্তা হওয়ার মূল গুণগুলো কী
- সেগুলো অর্জনের উপায় কী
- নিজের মাঝে থাকা ভুল অভ্যাস কোনগুলো, যা সেই গুণ অর্জনে প্রতিবন্ধক
অভিজ্ঞতা হবে দ্বিমুখী—নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। এভাবেই নিজেকে নিজেই সঠিকভাবে বিচার করতে শেখা সম্ভব।
এই বইয়ের রচনায় এই বিশ্বাসগুলোই ছড়িয়ে আছে, ব্যাখ্যা ও উদাহরণের মাধ্যমে। পাঠককে শুরুতেই নিজে জানা বিষয়ের উপর কথা বলতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ, অন্তরের শক্তি, ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বক্তব্য তৈরি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এই বইয়ের মূল বার্তা: পদ্ধতি গৌণ; পূর্ণ মন, উষ্ণ হৃদয় ও দৃঢ় ইচ্ছাই মুখ্য। কারণ, যদি মানুষটিই পূর্ণ না হয়, তবে তাকে শেখানো যাবতীয় পদ্ধতি নিছক কাঠের মূর্তিকে মানুষের পোশাক পরানোর মতো।