কুরআন পরিচিতি
কুরআনুল কারীম মহান আল্লাহর কিতাব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এটিকে লাওহে মাহফুজে সংরক্ষণ করেছিলেন। সেখান থেকে পুরো ত্রিশ পারা একত্রে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ করা হয়েছিল। এরপর প্রথম আসমান থেকে ২৩ বছরে পর্যায়ক্রমে আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাজিল করা হয়।
কুরআনের সুরার পরিচয় ও প্রকারভেদ
:
সুরা শব্দের অর্থ দেয়াল, প্রাচীর।
সুরার পারিভাষিক অর্থ বলা হয় কিছু আয়াতে সমষ্টিকে, যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর নির্দেশে একত্রিত করেছেন এবং একটি নির্দিষ্ট নাম দিয়েছেন।
সুরা ২ প্রকার : ১. মক্কী ২. মাদানী
মক্কী সুরা: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পূর্বে যেসব সুরা নাজিল হয়েছে সেগুলোকে বলা হয় মক্কী সুরা।
মাদানী সুরা: মদিনায় হিজরতের পর যেসব সুরা নাজিল হয়েছে সেগুলোকে বলা হয় মাদানী সুরা।
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা মোট ৮৬ টি আর মদিনায় অবতীর্ণ সুরা মোট ২৮টি। মোট সুরা: ১১৪টি।
কুরআনুল কারীম খুবই কঠিন তাকে সহজ করা হয়েছে
কুরআনুল কারীম মূলত কঠিন ও খুব ভারী কালাম। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ
إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا -
'আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করব ভারী কালাম।'
হুসাইন ইবনে ফজল রাযি. এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, কুরআনুল কারীম এমন ভারী কালাম, যার হৃদয় খাঁটি, একত্ববাদে অলঙ্কৃত এবং আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক ক্ষমতা দানে ক্ষমতাবান, সে ছাড়া অন্য কারও তা বহন করার সাধ্য নেই। এদিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়, কুরআনুল কারীম হিফজ করাও মূলত কঠিন ব্যাপার নয়; আর বাস্তবেও তাই। শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহে তাঁর প্রিয় বান্দাদের ওপর তা সহজ করে দিয়েছেন। যেমন, তিনি ইরশাদ করেন-
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ আমি কুরআনুল কারীম সহজ করে দিয়েছি হিফজ করার জন্য।
হযরত হাসান রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি আল্লাহ তায়ালা-
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ
এ আয়াতটি অবতীণ না করতেন, তবে কারো পক্ষে কুরআনুল কারীমের কোনো শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব হতো না।
হিফজ করা কুরআনুল কারীমের বৈশিষ্ট্য
হিফজ করা একমাত্র কুরআনুল কারীমেরই স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য। পূর্বেকার আসমানী কিতাবসমূহ হিফজ করা সম্ভব ছিল না। তাফসীরে কাশাফে সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব রহ. বলেন, 'কুরআনুল কারীম ব্যতীত অন্যান্য আসমানী কিতাব হিফজ করা যেত না।'
হিফজ করা কুরআনুল কারীমের বৈশিষ্ট্য হওয়া সম্পর্কে মুফাসসিরিনগণ বলেছেন, অন্তরে সংরক্ষণ করা শুধুমাত্র কুরআনুল কারীমের বৈশিষ্ট্য। পূর্বেকার উম্মতগণ তাদের কিতাব শুধু দেখে দেখে পড়তো। যখন তারা কিতাব বন্ধ করে দিত, তখন কারো কোনো কিছু স্মরণ থাকত না একমাত্র নবীগণ ব্যতীত। আর এ কথার কোনো প্রমাণ নেই যে, কারুনের তাওরাত মুখস্থ ছিল।'
রবি ইবনে আনাস রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- অর্থাৎ, আকাশ থেকে অবতরণকৃত তাওরাত সত্তর উটের বোঝার মতো ছিল। তার একটি অংশ দেখে দেখে পড়তে এক বছর লেগে যেতো। মুসা আলাইহিস সালাম, ইউশা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম; এ তিনজন ছাড়া অন্য কেউ হিফজ করেনি।
কুরআনুল কারীম কেন হিফজ করবেন?
এতে কোনো সন্দেহ নেই, কালামে পাক হিফজ করার ক্রমধারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে শুরু হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় কতজন হাফেজ ছিলেন। ইমাম গাযালী রহ. ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন। 'ইহইয়াউল উলুম' কিতাবে লিখেছেন, সাহাবায়ে কেরাম আমল ও সাধনার মধ্যে তাদের জীবন উৎসর্গ করে ছিলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ হাজার সাহাবি রেখে ইন্তেকাল করেন। যার ফলে বেশিসংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম রাযি. হিফজ করতে পারেননি। মাত্র ছয়জন কুরআনুল কারীমে হিফজ করেছিলেন। তন্মধ্যে দুজনের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামের এক দুটি সূরা মুখস্থ ছিল।
মোটকথা, কালামে পাকের নাজিল এক এক আয়াত ও এক এক সূরা নাজিল হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ওহী (ঐশী প্রত্যাদেশ) অবতরণকালে যারা উপস্থিত থাকতেন, তারাই কেবল কুরআনুল কারীম লিপিবদ্ধ ও মুখস্থ করে নিতেন। সুতরাং ওহী অবতরণকালে যারা বেশি উপস্থিত থাকতেন, তারাই অধিকাংশ সূরা আয়ত্ত ও লিপিবদ্ধ করেছেন। আর যাদের উপস্থিতি কম হতো, তারা বেশি সূরা আয়ত্ত করতে পারেননি। অতএব, প্রত্যেকের পুরো কুরআন হিফজ না হওয়ার কারণ এটাই ছিলো যে, কালামে পাক সম্পূর্ণ একত্রিত ছিলো না। নতুবা হিফজের জন্য তাঁদের আগ্রহ কম ছিলো না। এ কারণেই কিছুদিন পর যখন সমস্ত সুরা ও আয়াত একত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়, তখন সাথে সাথে হাফেজদের সংখ্যা বেড়ে গেল এবং যথেষ্টসংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম রাযি. হিফজ করে নিলেন।
কুরআন তেলাওয়াতের আদব
পূর্ণ কুরআনুল কারীম হিফজ করা ফরযে কেফায়া ও সুন্নাতে আইন। 'মুনিয়াতুল মুসুল্লী' গ্রন্থের শরাহ কাবীরীতে উল্লেখ আছে, যে পরিমাণ কুরআনুল কারীম নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য প্রয়োজন, তা মুখস্থ করা প্রত্যেক বিবেকবান প্রাপ্তবয়স্কের উপর ফরযে আইন এবং সূরা ফাতেহাসহ অন্য একটি সূরা হিফজ করা ওয়াজিব। সম্পূর্ণ কুরআনুল কারীম হিফজ করা ফরজে কিফায়া ও সুন্নাতে আইন, যা নফল নামাযের তুলনায় উত্তম।
'মাযাহেরে হক' নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, নামায শুদ্ধ হয়; এতটুকু পরিমাণ কুরআন মুখস্থ করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন এবং সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করা ফরযে কিফায়া। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যদি কেউ পূর্ণ কুরআন শরিফ মুখস্থ করেন, তবে অবশিষ্ট সবাই দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যাবে এবং সূরা ফাতেহাসহ একটি সূরা মুখস্থ করা সকল মুসলমানের উপর ওয়াজিব।
কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ফায়দা
১. দিল পরিস্কার হয়-আল হাদিস
২. আল্লাহ তায়ালার মহব্বত ও নৈকট্য লাভ হয়। (হাদিসের ভাবার্থ)
৩. প্রত্যেক হরফে কমপক্ষে দশ নেকী পাওয়া যায়। চাই সে বুঝে পড়ুক বা না বুঝে। যারা বলে না বুঝে পড়লে লাভও নাই তাদের কথা ভুল। -আল হাদিস