"জাপানযাত্রী" বইটি সম্পর্কে কিছু কথাঃ ‘জাপানযাত্রী’ একাৰ্থে জাপানীদের ইতিহাসকেও টেনে এনেছে। শুধু যে জাপানের জাতি-সংস্কৃতি নিয়ে কথা হয়েছে তাই কিন্তু নয়। এখানে কবি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং সেখান থেকেই কথাগুলাে একের পর এক উঠে এসেছে। জাপানে তিনি অবস্থান করছিলেন চমৎকার বাগান সমৃদ্ধ এক জায়গায়। জায়টিতে অনেকেই আসতাে বনভােজন করার জন্য। এই উন্মুক্ত জায়গা পেয়ে বুঝি কবিরও সুবিধে হয়েছিল। কারণ তিনি তাে সবর্দা প্রকৃতির বেড়াজালেই সুন্দর থেকে সুন্দরতম হয়ে উঠেছিলেন। যেমন জাপানি নাচের কথাই বলা যায়, তাদের নাচও কিন্তু তাদের নিজেদের মতাে । রবীন্দ্রনাথ যেন তাদের নাচের সঙ্গে তাদের মানসিকতারও মিল খুঁজে পেয়েছিলেন, একদিন জাপানি নাচ দেখে এলুম। মনে হল, এ যেন দেহভঙ্গির সংগীত । এই সংগীত আমাদের দেশের বীণার আলাপ। অর্থাৎ, পদে পদে মীড়। ভঙ্গিবৈচিত্র্যের পরস্পরের মাঝখানে কোনাে ফাঁক নেই কিংবা কোথাও জোড়ের চিহ্ন দেখা যায় না; সমস্ত দেহ পুষ্পিত লতার মতাে একসঙ্গে দুলতে দুলতে সৌন্দর্যের পুষ্পবৃষ্টি করছে। খাটি য়ুরােপীয় নাচ অর্ধনারীশ্বরের মতাে, আধখানা ব্যায়াম, আধখানা নাচ; তার মধ্যে লম্ফঝম্প, ঘুরপাক, আকাশকে লক্ষ্য করে লাথি-ছোঁড়াছুঁড়ি আছে । জাপানি নাচ একেবারে পরিপূর্ণ নাচ । তার সজ্জার মধ্যেও লেশমাত্র উলঙ্গতা নেই। অন্য দেশের নাচে দেহের সৌন্দর্যলীলার সঙ্গে দেহের লালসা মিশ্রিত। এখানে নাচের কোনাে ভঙ্গির মধ্যে লালসার ইশারামাত্র দেখা গেল না। আমার কাছে তার প্রধান কারণ এই বােধ হয় যে, সৌন্দর্যপ্রিয়তা জাপানির মনে এমন সত্য যে তার মধ্যে কোনােরকমের মিশল তাদের দরকার হয় না এবং সহ্য হয় না। তবে জাপানিদের সংগীত নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অনেকটা নিরাশই ছিলেন। তাদের নাচে যতটা মুগ্ধ ছিলেন কবি, গানে ততটাই দূরে ছিল তার ভালােলাগা । সারা বিশ্বেই জাপানিদের পরিশ্রমী জাতি হিসেবে বেশ সুনাম আছে। কাজ ছাড়া নাকি তারা কিছুই বােঝে না। কবিও দেখেছিলেন তাই, জাপানিরা শুধু কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।