নিজেকে পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন করার অপ্রচলিত মানসিকতা থেকে ৮০-র দশকে কবিতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী, ময়মনসিংহের গীতিকা, কখনও আলাওলের পদ্মাবতীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের ভেতর নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। একই-সাথে দেশি-বিদেশি শিল্পাচার্যদের বিভিন্ন মতবাদ আমকে বিমোহিত করে, অনুপ্রাণিত করে, ভাবায় এবং প্রভাবিত করে। সুররিয়ালিজম, দাদাইজম, কিউবিজম, ফবিজমের অলঙ্ঘনীয় আকর্ষণ আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশভঙ্গীতে পরিবর্তন আনে। আর এর ভেতর দিয়েই তৈরি হয় আমার কবিসত্তা। প্রায় নিভৃতে এক-দশক কবিতা চর্চা করার পর আমার প্রথম কবিতার বই আত্মপ্রতিকৃতি প্রকাশিত হয় ১৯৯১ খৃষ্টাব্দে। পরবর্তীতে শ্রীমঙ্গলে চা বাগানের নীরব এবং প্রকৃতির নিবিড় পরিবেশে জীবনযাপনের সময় ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় আমার ২য় কাব্যগ্রন্থ কাঠের পুতুল। পরবর্তী সময় দাপ্তরিক কাজ, টি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার কাজ, একই সাথে কলমের সংগ্রহশালা তৈরি, চা শিল্পের রোড ম্যাপ বানানো, নর্দান বাংলাদেশ এবং বান্দরবান চা প্রকল্প প্রস্তুত এবং বাস্তবায়ন, চা শিল্পের গবেষণা ও উন্নয়ন, দেশবিদেশে চা শিল্প বিষয়ক প্রশিক্ষণ, সেমিনার সিম্পোজিয়াম-এ অংশগ্রহণ, এই সব বিবিধ কাজে ব্যস্ত থাকি। চাকুরি থেকে ২০২২ খৃষ্টাব্দে অবসর গ্রহণের পর ২০২৪ খৃষ্টাব্দে খড়িমাটি থেকে আমার নতুন ৪টি এবং পূর্বপ্রকাশিত ২টি বইয়ের ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। নতুন ৪টি বইয়ের মধ্যে ১টি সনেট, ১টি অনু কবিতা, ১টি কবিতার বই এবং সর্বশেষটি চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা ৩৩ বৎসরের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা গল্পের বই। তবে বইয়ের ১ম গল্পটি ২০০৬ খৃষ্টাব্দে লেখা।
খড়িমাটির স্বত্বাধিকারী মনিরের কাছ থেকে রচনাসংগ্রহ প্রকাশের প্রস্তাব আমার নিজের জীবনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বিবর্তন, এবং ক্রমবিকাশকে পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নের অভাবনীয় সুযোগ বিবেচিত হওয়ায় আমি তা সানন্দে কৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করি। এতে করে এক মলাটে আমার ভেতর উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট চিন্তা ও মননের দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম একই সাথ নিজের সাথে নিজের লড়াই ও সমোঝোতা অনুধাবন করা যাবে। আমি লক্ষ্য করেছি আমার মস্তিষ্কের ভেতর একই সাথে পরস্পর বিরোধী একাধিক মানুষের চিন্তা অংকুরিত হয়েছে। তা পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়ে প্রতি মুহূর্তে আমাকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতর আটকে ফেলতে চায়-আমাকে সীমাবদ্ধ করে। আর এই ভয়াবহতা অবলোকন করার পর আমি নিয়ত বিস্মিত হই এবং তা অতিক্রম করার জন্য মৌনতাকে বার-বার আহ্বান করি। নিজের চিন্তাকে শূন্য করে আমার পক্ষ থেকে চিন্তা করার দায়িত্ব দেই সেই প্রাণবন্ত চেতনাকে, যা অদ্বৈত, অবিনশ্বর এবং সর্বত্র; যা একই সাথে আমার ভেতর ক্রম প্রবাহমান-সম্প্রসারণশীল এক জগতকে জন্ম দিচ্ছেÑযা অন্তর্গত মুখরতাকে প্রতিস্থাপিত করে মনের মৌন জমিতে পূর্ণ ভালোবাসার চাষাবাদ করে-সেখানে লুকিয়ে আছে আমার শিল্পচর্চার শিকড়। আর তা হিংসা বিদ্বেষ এবং প্রতিযোগিতা’কে অবলীলায় অতিক্রম করে; যা স্থির, অনমনীয়, ঋজু, নিঃসঙ্গ, অবিচল, প্রবীণ এবং স্বতঃস্ফূর্ত। এক মলাটের ভেতর আমি ছিন্নভিন্ন খরস্রোতা এক মূখর পাহাড়ি ঝরনা থেকে রূপান্তরিত হয়েছি মৌন-স্থির চিন্তাশূন্য সরোবরে-আর তা ‘সত্য স্বচ্ছ ও নির্জলা ভালোবাসায় পূর্ণ’।