ভূমিকা
আল্লাহতায়ালা মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং যুগে যুগে জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য ছহিফা বা কিতাব পাঠিয়েছেন। তার-ই ধারাবাহিকতায় হযরত মোহাম্মদ (স.) শেষ নবী ও আল কুরআন শেষ আসমানী কিতাব। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এই কুরআনের আলোকেই তার জীবনযাপন করছেন। তাই নবীজীকে অনুসরণ করা হলে কুরআনেরও অনুসরণ করা হবে তাতে সন্দেহ নেই। আর নবীজীকে অনুসরণ করতে হলে পড়তে হবে, জানতে হবে, শুনতে হবে। এই জানানোর প্রচেষ্টার ফসলই হলো বর্তমান গ্রন্থ ‘মানুষ যাকে ভুলেনি’। হযরত মোহাম্মদ (স.) এর জীবন অধ্যায়ন আমাদের নৈতিকতা, ধৈর্য্য, সহানুভূতি, আমানতধারী ও মানবতার শিক্ষা দেয়। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে আমরা শান্তিপূর্ণ, ন্যায় ভিত্তিক ও কল্যাণময় জীবন গঠন করতে পারি। ইসলামের মূল বার্তা বুঝতেও তাঁর জীবনী জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অত্রগ্রন্থে মোট ১২ টি প্রবন্ধ সংকলিত করা হয়েছে। প্রবন্ধগুলি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। প্রবন্ধগুলি পাঠকের জীবনে বিশেষ মূল্যবৃদ্ধি করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অত্র গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছেন মুহাম্মদ নুরুল হক। প্রবন্ধটির ক্ষুদ্র পুস্তিকা আকারে বাহাত্তর বছর পূর্বে সিলেটের আল ইসলাহ পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সার্বিক বিবেচনায় আমরা এ গ্রন্থে প্রবন্ধটির সংযোজন করেছি। প্রবন্ধটির মাধ্যমে লেখক বুঝাতে চেয়েছেন একজন ব্যক্তির পক্ষে বিশ্বনেতা হতে হলে যে সকল গুণ থাকা বাঞ্ছনীয় তার সবগুলোই প্রিয় নবী (স.) এর জীবনে বর্তমান ছিল। তিনি চারটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দের উল্লেখপূর্বক প্রমাণ করেছেন কেন হযরত মোহাম্মদ (স.) সরওয়ে আলম বা বিশ্বনেতা।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি রচনা করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক সানাউল্লাহ নূরী। প্রবন্ধকার বেশ কিছু নির্ণায়কের ভিত্তিতে দেখাতে চেয়েছেন কেন মানুষ মুহাম্মদ (স.) স্মরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। নির্ণয়কগুলোর মধ্যে রয়েছে তিনি পৃথিবীতে কুরআনের আলোকে মহাপরিবর্তন এনেছিলেন, অন্ধকার যুগকে আলোয় ভরে দিয়েছিলেন, অশান্তির পৃথিবীতে শান্তি এনেছিলেন, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের জয় ঘোষণা করেছিলেন, বহু-ইশ্বরবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন ইত্যাদি। প্রবন্ধটি পাঠকদের মন কাড়বে সন্দেহ নেই।
তৃতীয় প্রবন্ধটি উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আল্লামা আবুল হাশিম কর্তৃক রচিত। তাঁর মতে, দর্শন শাস্ত্র জীবন ও জীবন যাপনের ব্যাপারে একটি দৃষ্টি ভঙ্গি। তাই মানুষের জীবনে দার্শনিক চিন্তা ভাবনা একটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই বিষয়টিকে সামনে রেখেই বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদকে তিনি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন এ প্রবন্ধে। ভূল দার্শনিক দৃষ্টি ভঙ্গি মানুষের ক্ষতির কারণ হয়। প্রবন্ধটি পাঠকদের চিন্তা শক্তিকে আরো প্রখর করবে।
চতুর্থ প্রবন্ধটির লেখক অধ্যাপক শাহেদ আলী। তাঁর প্রবন্ধের নাম “মানবতার আদর্শ”। শিরোনামই বলে দিচ্ছে বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহতায়ালা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কাউকে সৃষ্টি করেননি। পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষই তার বান্দা। ভাষা বর্ণের পার্থক্য মানুষকে চেনার জন্য আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন। দৃঢ়ভাবে কুরআন ও হাদিসে এ কথাই প্রতিফলন হয়েছে যার মধ্যে যতবেশি আল্লাহর ভয় বিদ্যমান সেই ব্যক্তি তত বেশি সম্মানিত। প্রবন্ধটির প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জাত-পাত নয়, মানবতার আদর্শই মানুষের বড় আদর্শ।
পঞ্চম প্রবন্ধটির রচয়িতা ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম “মহানবী (স.) এর যুগে উপমহাদেশ”। হযরত মোহাম্মদ (স.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার মরুভূমিতে জন্মগ্রহণ করেন। লেখক উল্লেখ করেন, ঐ সময় আল্লাহর নিকট থেকে নাজিলকৃত সকল ধর্ম গ্রন্থকেই মানুষ নিজের খেয়াল খুশি মতো বিকৃত ও পরিবর্তন করে বসে ছিলেন
এক স্রষ্টার উপর বিশ্বাস না রেখে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে স্রষ্টা ভেবে সাহায্য প্রার্থনা হীনমন্যতায় ভুগছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) এর আগমনে কিভাবে ঐ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল এবং আরব ছাড়াও সারা বিশ্ব বিশেষ করে উপমহাদেশ তথা বাংলার ইতিহাস ইসলামের আলোকে যে এক নীরব বিপ্লব ঘটেছে প্রবন্ধকার সেই দাবি-ই উত্থাপন করেছেন এ প্রবন্ধে।
ষষ্ঠ প্রবন্ধটি বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ এ জেড এম শামসুল আলম কর্তৃক রচিত। প্রবন্ধকার এ প্রবন্ধে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যে, মহানবী (স.) তার জীবন-কালে যে সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করেছেন সেখানে তিনি মুজেযার চেয়ে সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে যে সকল বাঁধাসমূহ অতিক্রম করেছেন সাধারণ মানুষ থেকে অতি মানবে পরিনত হওয়ার আগ্রহ দেখাননি।
সপ্তম প্রবন্ধটি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) যে, সমাজে সাম্যের প্রতিষ্ঠায় এক দক্ষ কারিগর ছিলেন সেটাকেই লেখক তার প্রবন্ধে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। ঐ সময়ে অর্থ সম্পদ প্রতাপ ক্ষমতা, গাত্র-বর্ণ, ভাষা, বংশ, গোত্র পরিবার সব শেষে পিতা-মাতার পরিচয়ে মানুষ যখন পরিচিত হতেই শুধু অভ্যস্ত ছিল না বরং এগুলোর ভিত্তিতেই যখন মানুষের মান-মর্যাদা, সম্মান- সম্ভ্রম নির্ধারিত হচ্ছিল, তখন তিনি তার যুক্তি নির্ভব বাণীর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর নিকট এ সব অনর্জিত মানদণ্ডের দুর্বলতা ও অগ্রহণযোগ্যতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে তুলে ধরতে সক্ষম হন। প্রবন্ধকার ইসলামে সাম্যবাদীর বিষয়টি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।
জুবাইদা গুলশান আরার জ্ঞানগর্ভ কিন্তু সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটি অত্র গ্রন্থের অষ্টম প্রবন্ধ। হযরত মোহাম্মদ (স.) এর আগমনের পূর্বে আরব বিশ্বের যুগকে আমলে জাহিলিয়াত হিসেবে গণ্য করা হতো। হযরত মোহাম্মদ (স.) এর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটার মাধ্যমে আরব বিশ্ব জ্ঞানে, আচার ব্যবহার ও নৈতিকতার আলো জ্বলে উঠে। আর সেই আলোই প্রিয় নবী (স.)। আল্লাহতায়ালা নিজে মহানবী (স.) সিরাজাম মুনীরা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
নবম প্রবন্ধটির রচয়িতা অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তার প্রবন্ধটির শিরোনাম রাব্বানী প্রজ্ঞায় স্রষ্টা, সৃষ্টি ও মানুষ”। এখানে ক্ষুদ্রতম সৃষ্টির পক্ষে স্রষ্টাকে পুরোপুরি ধারণ করা অসম্ভব হলেও স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুধাবন করা অসম্ভব নয়। সেই বিষয়টিকেই অত্র প্রবন্ধের মূল বিষয় হিসেবে আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধটি পাঠে পাঠকদের আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারবেন এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এবং স্রষ্টাকে চিনে নেওয়ার প্রচেষ্টা একটু হলেও জাগ্রত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এ প্রচেষ্টা সফল হলেই বান্দা পাবে সেই কাঙ্খিত ডাক, হে নিশ্চিত নিঃশব্দ আত্মা। আনন্দচিত্তে, পরিতৃপ্ত ও উল্লাসিত হয় ফিরে এসো নিজ রবের দিকে। আমার প্রিয়তম বান্দাদের ভেতর শামিল হয়ে যাও আর প্রবেশ কর জান্নাতে ( ফজর: ২৭-৩০)।
দশম প্রবন্ধটির রচয়িতা ড. মোহাম্মদ একরামুল ইসলাম। প্রবন্ধটিতে রসূল (স.) এর জীবনাদর্শ ও শিক্ষা দর্শন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের অস্থির পরিস্থিতিতে নবীজীর জীবনাদর্শ কিভাবে বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে তার এক দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রবন্ধটি তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক আয়োজিত ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) উপলক্ষে নভেম্বর ১৫, ২০২৪ তারিখে বায়তুশ শরীফ অডিটোরিয়াম, ফার্মগেট, ঢাকা তে পঠিত হয়েছিল। প্রবন্ধটিতে সমকালে মহানবী (স.) এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
একাদশ প্রবন্ধটি ড. মোঃ মুহসিন উদ্দিন কর্তৃক রচিত। প্রবন্ধটিতে নেতৃত্ব কি? নেতার কি কি গুণাবলি থাকা অপরিহার্য গবেষকদের বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে তার একটি দিক নির্দেশনা মূলক আলোচনা করেছে এবং সার্বিক গুণাবলির ভিত্তিতে মহানবী (স.) যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা তা-ই প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন।
দ্বাদশ প্রবন্ধ ড. আহমেদ আবুল কালাম এর গবেষণার ফল। সারা বিশ্বের যে অস্থিরতা ও অশান্তি বিরাজ করছে তার প্রধান কারণ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর স্বার্থপরতা ও ইসলাম ধর্মের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ। এই অস্থিরতা কাটিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে নেতার নেতৃত্ব যা সমগ্র বিশ্ববাসীর একবাক্যে মেনে নিবে। প্রবন্ধকার মনে করেন সেই নেতাই হলো মহানবী (স.)। কেন মনে করেন সেই উত্তরই অত্র প্রবন্ধে দেয়ার চেষ্টা করেছেন প্রবন্ধকার। প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে তথ্যবহুল। পুরো গ্রন্থটি পাঠকদের সুখপাঠ্য হবে ও পাঠকদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে বলে আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি।
গ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমি তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক ও সাধারণ সম্পাদক মেজর (অব.) জামিল আহমেদ এর নিকট কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তৃণলতা প্রকাশ-এর কর্ণধার জাহাঙ্গীর আলম-এর নিকট। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে বইটি পাঠকদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছে। আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছেন জনাব মোঃ শরিফুল আলম পি এস (ড. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, সাবেক এমপি, ঢাকা-১৯, ও সাবেক সভাপতি, ঢাকা জেলা বিএনপি) আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
পাঠকবৃন্দ গ্রন্থটি সাদরে গ্রহণ করলেই আমাদের শ্রম স্বার্থক হবে বলে মনে করি। গ্রন্থটিতে ভুল থাকা অসম্ভব নয়, তবে পাঠকদের দৃষ্টিতে ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়লে এবং আমাদের অবহিত করলে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা হবে ইন-শা-আল্লাহ।
ড. মোহাম্মদ একরামুল ইসলাম
সেপ্টেম্বর ২০২৫, ঢাকা, বাংলাদেশ।