কোন কোন কার্যকলাপকে “মহাকাশ কার্যকলাপ” বলা হবে? যদি কোনো দেশ পৃথিবীতে অবস্থিত একটি ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করতে মহাকাশ-নির্ভর স্যাটেলাইট ব্যবহার করে, এবং সেই ড্রোন কোনো সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে মিসাইল ছোড়ে, তাহলে কি সেটি মহাকাশ চুক্তি লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে? যদি ব্যবহৃত উপগ্রহটি বাণিজ্যিক হয়, তাহলে কি সেটি এবং তার পুরো নেটওয়ার্ককে এখন অস্ত্র ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা যায়?
২০০৪ সালে ইরাক যুদ্ধের সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে গোলাবারুদ ব্যবহার করেছিল, তার ৬৮ শতাংশই ছিল স্যাটেলাইট-নিয়ন্ত্রিত, এবং এর ৮০ শতাংশই ছিল বাণিজ্যিক উপগ্রহের মাধ্যমে পরিচালিত। এখন প্রশ্ন ওঠে, যদি ইরাকের সে সময় স্যাটেলাইটে হামলা চালানোর প্রযুক্তি থাকত, তাহলে কি তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেই উপগ্রহগুলোতে আঘাত হানার অধিকার রাখত?
এই প্রশ্ন আরও জটিল আকার নেয় ২০২২ সালে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের প্রথম দিকেই ইউক্রেনের শহর ইরপিন পুরোপুরি ইন্টারনেট সংযোগ হারায়, তখন তাদের ২৪টি মোবাইল বেস স্টেশনের সবকটিই বন্ধ হয়ে যায়, এর মধ্যে বেশিরভাগই রুশ মিসাইল হামলায় ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু মাত্র দুই দিন পর, সংযোগ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। এটি সম্ভব হয় কারণ ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স দ্রুত সেখানে স্টার লিংক হাই-স্পিড ইন্টারনেট টার্মিনাল পাঠায়, যেগুলো লো আর্থ অরবিটে থাকা উন্নত স্টারলিংক উপগ্রহগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এরপর পুরো ইউক্রেনজুড়ে ১০,০০০-এর বেশি টার্মিনাল বিতরণ করা হয়।
এর অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ব্যবহার করলেও, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীও এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে যোগাযোগ বজায় রাখে, যার মাধ্যমে তারা তাদের ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করে এবং টার্গেট সংক্রান্ত তথ্য সরাসরি কমান্ডারদের কাছে পাঠায়। রাশিয়া চেষ্টা করেছিল এই টার্মিনাল ও উপগ্রহের মধ্যে সিগন্যাল জ্যাম করতে, কিন্তু স্পেসএক্স দ্রুতই সেই হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার কৌশল আবিষ্কার করে।
এই ঘটনাগুলো মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিল মস্কো ও ওয়াশিংটন, কারণ এটি মহাকাশ-যুদ্ধনীতির এক নতুন অধ্যায় খুলে দেয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার পরিচালক ডেভ ট্রেম্পার মন্তব্য করেন: “আমাদেরও এই ধরনের দ্রুততা অর্জন করতে হবে।” অন্যদিকে, রুশ মহাকাশ সংস্থা রসকসমসের প্রধান দিমিত্রি রগোজিন অভিযোগ তোলেন যে, স্টারলিংক কার্যত পেন্টাগনের অংশ হয়ে কাজ করছে।
যদি সেই অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে, রাশিয়া কি বৈধভাবে স্টারলিংক উপগ্রহে আক্রমণ চালাতে পারত? কারণ এই উপগ্রহগুলো রুশ সেনাদের হত্যার অভিযানে সহায়তা করছিল।
আরও একটি সম্ভাব্য দৃশ্য কল্পনা করুন:
যদি চীনে কোনো সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে একটি সফল বিদ্রোহ শুরু হয়, এবং স্টারলিংক সেই দেশের ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’ (ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) পাশ কাটিয়ে নাগরিকদের জাতীয় পর্যায়ে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়, তাহলে চীন কী করবে? এমন পরিস্থিতির জন্যই এখন বড় শক্তিগুলো আগে থেকেই পরিকল্পনা করছে।
২০১৯ সালে ন্যাটো তার কার্যক্রমের ক্ষেত্র হিসেবে স্থল, আকাশ, সমুদ্র ও সাইবারস্পেসের পাশাপাশি ‘মহাকাশ’কে যুক্ত করে। এরপর ২০২০ সালে তারা সিদ্ধান্ত নেয় একটি স্পেস সেন্টার স্থাপনের, যা ২০২১ সালে জার্মানির রামস্টাইনে উদ্বোধন করা হয়। এই কেন্দ্রটিতে ন্যাটোর বিভিন্ন সদস্য দেশের বিশেষজ্ঞরা কাজ করেন। তাদের কাজ হলো নেভিগেশন, আবহাওয়া ও সম্ভাব্য হুমকি সংক্রান্ত তথ্য সব সদস্য দেশের মধ্যে সমন্বয় করা। যদিও ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কিছু ভুমিকা রয়েছে, তবুও ন্যাটো এখনও গোয়েন্দা তথ্য, লক্ষ্য নির্ধারণ ও প্রচলিত যুদ্ধ পরিচালনার প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল।