কবিতা মানুষের অধিগম্য শব্দ সমষ্টির বিন্যাস মাত্র। কবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায়; জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মুশিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মতো স্নান না করে বরং আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের সাদা রৌদ্রের মতো সৌন্দর্য নিরাকরণের স্বাদ পাওয়া যায়। সুতরাং রাতের সৌন্দর্যকে কবিতায় রূপান্তরিত করে অনির্বাণ শিখায় প্রজ্বলিত করাই কবির ধ্যান-জ্ঞান এবং প্রজ্ঞাময় প্রচেষ্টা।
কবি তারক পাল এর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বিষণ্ন সূর্যের দেশে’ কবিতাগ্রন্থে হৃদয়ের সঞ্চিত কল্পনা এবং চিন্তা প্রসূত অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা দিয়ে কবিতার পঙ্ক্তিমালা নির্মাণ করেছেন। কবি মানসে ভাবগত দর্শন, বুদ্ধিভিত্তিক মোড়লীপনা জীবনবোধে কাব্যরসের সঞ্চার করলে কেবল তা অক্ষর বিন্যাসে কবিতা হয়ে ওঠে এ প্রমাণ তিনি তার কবিতাগ্রন্থে তুলে ধরেছেন। ‘বিষণ্ন সূর্যের দেশে’ শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেন— আজও আমি হেঁটে যাই পথহীন মাঠের ভেতর/আমার চেনা পায়ের শব্দ কেঁপে ওঠে শূন্যতায়/ধান ক্ষেতের ওপরে উড়ে যায় এক বুনো শালিক/তাঁর ডানায় পড়ে থাকে রোদ্দুরের শেষ আঁচল। এই কবিতার অন্তর জুড়ে কবি গড়ে তুলেছেন মননশীল চিন্তার আবাস। তাঁর কবিতায় জীবনানন্দীয় ঘ্রাণ অনুভূত হয়।
প্রেম ও বিরহ তাঁর কবিতায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। না পাওয়ার দুঃখ কিংবা পেয়ে হারানোর ব্যথায় কবি ‘বিষণ্ন সূর্যের দেশে’ কখনো একা কখনো প্রেমিকার ছায়াসঙ্গী হয়েছেন। ‘নিস্তব্ধতার বুক জুড়ে তুমি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন— তুমি নেই-তবু আছো বুক ভরা শূন্যতার ভিতরে/তুমি নেই— তবু রক্তে দগ্ধ আগুনের মতো/ জ্বলে থাকো প্রতিটি নিশ্বাসে। কবি তারক পাল নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন, সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহারে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে।
কবি মননে ভাববাদী চিন্তার আবাস গড়েছেন বলেই তাঁর কবিতায় উচ্চমার্গীয় দর্শনবোধ কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কবিতাগ্রন্থে প্রেম-বিরহ-ই যেন কবিতার অনুষঙ্গ। কবির নিরব প্রার্থনা-পুরনো প্রেমের গাণিতিক সূত্র ধরে ফিরে আসে ভালোবাসার অবগুণ্ঠিত প্রেমিকা; নরম রোদের আলোয় কিংবা জোছনা ধবল রাতের স্নিগ্ধ হাওয়ায়।
‘অশ্রুতে লেখা প্রতিশ্রুতি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন তবুও আমি শপথ করছি/ আমার এ ব্যর্থ প্রেম, এ ব্যথার আগুন/ একদিন জ্বলে উঠবে মানবতার নামে/ অশ্রুতে লেখা এ প্রতিশ্রুতিই হবে/ অন্ধকার ভাঙার দীপ্ত শিখা। তিনি কবিতায় শাশ্বত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, প্রেম-বিরহ, শাসন-শোষণের তত্ত্বগুলো সাবলিলভাবে তুলে ধরেছেন। কাব্য সৃষ্টির এ এক নতুন ধারা, যা কবিতাপ্রেমি পাঠককে ঋদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
কবি তারক পাল এর কবিতায় নান্দনিক শব্দচয়ন কবিতার সৌন্দর্যকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন। তাঁর কবিতার স্বতন্ত্র ধারা অব্যাহত থাকুক এই প্রত্যাশা করতেই পারি। আমার প্রত্যাশা কবিতাপ্রেমিক পাঠক ‘বিষণ্ন সূর্যের দেশে’ কবিতাগ্রন্থটিকে প্রেমিক প্রেমিকার মতোই ভালোবেসে হৃদয়াঙ্গম করতে সক্ষম হবেন।
সালাম তাসির
কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও নাট্যকার।