প্রাগৈতিহাসিক কালে গুহামানবেরা যখন ভাষাজ্ঞান কিছুটা রপ্ত করেছে তখন থেকেই সুরধ্বনির সঙ্গে ছন্দবদ্ধ কথামালার প্রকাশ তারা করে আসছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারায় ভাষারও পরিবর্তন হয়েছে নানাভাবে নানারূপে। কিন্তু কাব্য চর্চার চিরন্তনী পৌরাণিক ধারাটি রয়ে গেছে আজও।
আর কাব্যসাহিত্যে ছড়া হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আগের দিনের লোককবিরা হাটে-মাঠে-ঘাটে আসরে মুখে মুখে ছড়া আওড়াতেন Ñ যা নানা রকম ভাঙচূড়ের মধ্য দিয়ে এখন নাম না জানা কবির প্রচলিত ছড়ার সনাতন রূপ নিয়েছে। বাংলা সাহিত্যের জন্মলগ্ন থেকেই মা-খালা-ফুপু তথা মাসী-পিসী দাদী-নানী বা ঠাকুর মা’দের ঘুমপাড়ানি ছেলেভুলানো ছড়া বাংলার আবহমান সাহিত্যের রত্ন ভাণ্ডার। বাংলার প্রাচুর্যময় লোকসাহিত্যের ভাণ্ডারে ছড়া বিশেষ স্থান দখল করে আছে নিসন্দেহে।
ছড়ার বিষয়বস্তু যেমন ঘুমপাড়ানী কিংবা হাস্যরস ও ননসেন্স তেমনি রাজনীতি, সমাজনীতি, সমাজের নানা অসঙ্গতি ও অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনা এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা Ñ যেনবা শব্দমালার বজ্রাঘাত বা শানিত কুঠারাঘাত হানা। এ জন্য ছড়াকে কালের কাব্যিক ইতিহাসও বলা চলে। বিশেষত সমকালীন বিষয়বস্তুর কারণে।
স্বরবৃত্ত ছন্দের নানা ভঙ্গি বা ফর্মে সহজ সরল ভাষায় রূপ ও রসের মাধুর্য এবং হাস্যরস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে ছড়া উপস্থাপন যেমন কঠিন তেমনি তা যদি যথাযথ হয় এবং পাঠকের মনে দাগ কাটে তাহলে তার স্থায়িত্ব হয় দীর্ঘ ও শাশ্বত।
ড. মুস্তাফা মজিদ কৈশোর থেকে [১৯৭০] ছড়া লেখেন এবং এদেশের একজন পরিচিত কবি ও ছড়াকার। তাছাড়া তিনি একজন মার্কসীয় দর্শনের গবেষক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লেখকও বটেন।
জনগণ কেবলমাত্র জনগণই হচ্ছেন সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস এবং বিশ্ব ইতিহাস সৃষ্টির চালিকা শক্তি-সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই লেখকের লেখার বিষয়বস্তু অনগ্রসর আদিবাসী সমাজ, সমকালীন রাজনীতি ও সমাজের নানা অসঙ্গতি। বর্তমানে দেশের অচল, অসুস্থ ও অস্থির গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ও সমাজনীতিই এ ছড়া গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য। আশাকরা যায় পাঠকদের ভালো লাগবে।
কবি ও গবেষক মুস্তাফা মজিদ এর রয়েছে ১০টি কাব্যগ্রন্থ। যথাক্রমে- ‘মেঘবতী সুবর্ণভূমি, “তােকে নিয়ে প্রেম প্রেম খেলা, কুসুমিত পঞ্চদশী’, ‘পুষ্পপত্রে নীলকণ্ঠ’, ‘জনযুদ্ধের কনভয়, ‘সাকিন সুবিদখালী’, ‘স্বাতীর কাছে চিঠি’, Diary of a Nepalese Guerrillas সম্পাদিত কবিতাসমগ্র ঃ মাও সেতুঙ এবং নিবেদিত কবিতা সংকলন ‘প্রাণিত রবীন্দ্রনাথ’ । এই কবি কবিতা লেখার পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসরত। মঙ্গোলীয় ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে লােক প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র নিয়েও গবেষণা করে আসছেন। বাংলাদেশের রাখাইন জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক সমীক্ষা নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। যা বাংলাদেশের রাখাইন’ শিরােনামে বাংলা ভাষায় বাংলা। একাডেমী এবং The Rakhaines শিরােনামে ইংরেজি ভাষায়। ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ড. মুস্তাফা মজিদের এ পর্যন্ত রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা। ৪০ উর্ধ্ব। তার উল্লেখযােগ্য গ্রন্থের মধ্যে ত্রিপুরা জাতি। পরিচয়’, ‘পটুয়াখালীর রাখাইন উপজাতি', আদিবাসী রাখাইন’, ‘মারমা জাতিসত্তা' বাংলাদেশে মঙ্গোলীয়। আদিবাসী’, ‘গারাে জাতিসত্তহজং জাতিসত্তা’, আদিবাসী সংস্কৃতি (১ম ও ২য় খণ্ড), রূপান্তরের দেশকাল’, ‘সমকালের আত্মকথন’, ‘লােক প্রশাসনের তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ’, ‘বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র', 'রাজনীতিতে সামরিক আমলাতন্ত্র’, ‘নেতৃত্বের স্বরূপ’, বাংলাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘মুক্ত ও মুগ্ধদৃষ্টির রবীন্দ্র বিতর্ক’ । আর ছােটদের জন্য রচিত ও সম্পাদিত গল্প গ্রন্থ। ‘দীপুর স্বপ্নের অরণি’, ‘জীবন থেকে’ ও ‘ছােটদের ৭টি মঞ্চ নাটক’ এবং জীবনী গ্রন্থ ‘রূপকথার নায়ক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন’ ও ‘বঙ্গবীর ওসমানী। মার্কসীয় মুক্ত চিন্তার যৌক্তিক দৃষ্টবাদে অবিচল মুস্তাফা মজিদ কৈশােরে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে। অংশগ্রহণসহ কৈশাের থেকেই নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। জড়িত । বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ছায়ানট, ঢাকা থিয়েটার ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। এছাড়াও তিনি সত্তর ও আশির দশকে শিশু-কিশাের। সংগঠন গড়া ও নাট্য আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন । পেশায় প্রথমে সাংবাদিকতা এবং পরে ১৯৮৪ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত আছেন। বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক ড. মুস্তাফা মজিদ ১৯৫৫ সালের ১৪ই এপ্রিল পটুয়াখালী জেলার সুবিদখালীতে জন্মগ্রহণ করেন । ভ্রমণ করেছেন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, জার্মানী, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ড।