“মাটির ঘ্রাণ” শুধু একটি কাব্য নয়, এটি এক আত্মিক অন্বেষণ; মাটি, মানুষ, প্রকৃতি ও মননের গভীরে প্রোথিত এক জীবনদর্শন। এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা যেন মাটির নিচ থেকে উঠে আসা শব্দবীজ, যা ভাষার আলো, ছন্দের বৃষ্টিতে স্নান করে পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যায়। কবি ফারুকুল ইসলাম মিয়াজি তাঁর কাব্যভুবনে যে সৃজন করেছেন, তা নিছক কল্পনা নয়, বরং বাস্তব জীবনের এক প্রতিচ্ছবি।
এই গ্রন্থের কবিতাগুলো আমাদের চেনা গ্রামীণ জীবনের কথা বলে; বলতে বলতে সে ছুঁয়ে ফেলে সমাজ, সংস্কৃতি, আর মানবতাকে। বাদলা দিনে, হেমন্ত, ফাগুন হাওয়া, আষাঢ়ের দিনে প্রভৃতি কবিতায় ঋতু ও প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য যেন চোখে দেখা যায়, নাকে লাগে মাটির সৌরভ। অন্যদিকে সভ্যতার পরাজয়, দ্বিপদী সব মানুষ নয়, ভণ্ডসাধু, তাদের তরে ঘৃণা, তুমি অমানুষÑ এই কবিতাগুলো কণ্ঠ তোলে অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে, উন্মোচন করে সমাজের অসাম্য ও ভণ্ডামির মুখোশ।
এই কাব্যের ভাষা সরল, প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। কবি খুব যত্ন নিয়ে ছন্দ রক্ষা করেছেন, অলংকার ব্যবহার করেছেন সুচারুভাবে, যাতে শব্দের ভারে নয়Ñ অভিব্যক্তির সৌন্দর্যে আলো ছড়ায় প্রতিটি চরণ। পরিচিত উপমা ও অনুসঙ্গের সাহচর্যে কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে চেনা অথচ নতুন, সাধারণ অথচ গভীর।
সোনার দামে তামা, চাষার দুঃখ, জেলের জীবন, উড়িরচর, পাহাড়ি মানুষ প্রভৃতি কবিতায় উঠে এসেছে শ্রমজীবী মানুষের মনের কথা, তাঁদের আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, অস্তিত্বের লড়াই। আবার তরিয়ে নিয়ো মোরে, সত্য বচন মুক্তি দেয়, পরশ্রীকাতরÑ এই কবিতাগুলো আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা, আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
কবি ফারুকুল ইসলাম মিয়াজি তাঁর কাব্যসাধনায় চেয়েছেন পাঠককে স্পর্শ করতে, নাড়িয়ে দিতে, হৃদয়ে দোলা দিতে। তাই তাঁর কবিতায় আছে মাটির গন্ধ, গ্রামের ঘ্রাণ; আছে প্রতিবাদের সুর, মানবতার আকুলতা এবং সময়ের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার সাহস। তাঁর কবিতা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং সকল শ্রেণির পাঠকের হৃদয় জয়ের এক আন্তরিক প্রচেষ্টা।
“মাটির ঘ্রাণ” একদিকে যেমন কাব্যিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ, তেমনি অন্যদিকে বাস্তব জীবনবোধে গভীর। এটি এক সঙ্গে চেনা ও অচেনা জগতের প্রতিচ্ছবি, যা পাঠকের হৃদয়ে সহজেই জায়গা করে নেবে।