ময়মনসিংহ জেলার দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে ময়মনসিংহ শহরের ইতিকথা নামে একটি প্রবন্ধ পঠিত হবে। আর এই প্রবন্ধ রচনার দায়িত্ব দেয়া হল আমাকে। পরবর্তীতে প্রকাশনা কমিটির এক সভায় ময়মনসিংহের জীবন ও জীবিকা গ্রন্থে এই প্রবন্ধটি ছাপা হবে বলেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এর মধ্যে লৌহিত্য নদের মধ্য দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কারণে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় ভাটা পড়ল। অনুষ্ঠানসূচি সংকুচিত হয়ে তিনদিনে তার সমাপ্তি টানা হল। তাই সেমিনারে প্রবন্ধপাঠ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ‘লৌহিত্য নদে’ বিসর্জন দেয়া হল। অতএব ‘ময়মনসিংহের জীবন ও জীবিকায়’ এটি আদৌ ছাপা হবে কিনা সে বিষয়ে এখন ষোলআনা সন্দেহ।
যাক, ময়মনসিংহ শহরের কাছে আমি একটি ঋণে বাঁধা আছি। এই শহর তার বুকে আমাকে স্থান দিয়েছে। এই অস্থায়ী পৃথিবীর ময়মনসিংহ শহরের এক নম্বর মহারাজা রোডে বর্তমানে আমার স্থায়ী ঠিকানা।
আমি সর্বপ্রথম ময়মনসিংহ শহরে আসি ১৯৪২ সালে। আমার এক স্নেহময়ী আত্মীয় মরহুম কামরুন্নেছা খাতুন (মরহুম আবদুল মালেক মজুমদারের স্ত্রী) সাহেবানের চিকিৎসা উপলক্ষে। একটা একতলা দালান ভাড়া করে প্রায় এক মাস নদীরপাড় থানার ঘাটে ছিলাম। সম্মুখে ছিল কয়েকটি ছোট ছোট হোটেল। এরপর ১৯৪৯ সালে এসে ভর্তি হই জিলা স্কুলে, থাকি আঠারো নম্বর টিকাপাড়া বাইলেনে আমার বোনের বাড়িতে। ১৯৫৪ সালে আনন্দ মোহন কলেজে পাঠপর্ব শেষ করে বিদায় নিই এই শহর থেকে। প্রায় আট বছর পর ১৯৬২ সালের ২৭ অক্টোবর আবার সপরিবারে এই ময়মনসিংহ শহরে এলাম। থাকলাম বোনের বাড়িতে আর ভাড়া বাসায়। ৩০ অক্টোবর ১৯৬৯ তারিখে মহারাজা রোডস্থিত বর্তমান আবাসটি কেনা হল। ১২ ডিসেম্বর ১৯৬৯ তারিখে নতুন বাসায় উঠলাম। সেই থেকে আমি ময়মনসিংহ শহরের বাসিন্দা। এর ভালো-মন্দ আমাকে ভাবায়। এই শহরে আমার ছোট মেয়ে ও দৌহিত্র-দৌহিত্রির জন্ম। তাদের নাড়ী পুঁতেছি এই শহরের মাটিতে। তাই এই ঋণের বোঝা কিছুটা হাল্কা করার জন্যই এই বইয়ের প্রকাশ। যাঁরা এই শহরে আছেন, থাকবেন, তাঁরা নিজেদের ঠিকানার পরিচয় পাবেন এই ক্ষুদ্র পুস্তকটিতে। পরিচয় না জানলে ভালোবাসা গাঢ় হয় না। আমার বিশ্বাস ময়মনসিংহ শহরের স্থায়ী নাগরিকরা এর অতীতকে জেনে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ায় অনুপ্রাণিত হবেন, সচেষ্ট হবেন।
আমার মূলবাড়ি অধুনা সুনামগঞ্জ জেলার সেলবরস পরগনার বীর গ্রামে। জানি না কীভাবে একটা মিল ঘটে গেল ময়মনসিংহের ইতিহাসে। ‘ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ পুস্তকের সম্পাদক, তৎকালীন জেলা বোর্ড সচিব জনাব শাকির উদ্দীন আহমদ সুনামগঞ্জ শহরের সন্তান। দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির প্রধান বর্তমান জেলা প্রশাসক জনাব এম এ মান্নানও সুনামগঞ্জ জেলার ডুংরিয়া গ্রামের অধিবাসী। তাঁরই অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন সম্ভব হয়েছে। সুনামগঞ্জের এই তিন সন্তানের এভাবে ময়মনসিংহের ইতিহাস রচনায় আবির্ভাব নিঃসন্দেহে কোনো চক্রান্তের ফল নয়, ঘটনাচক্রের ফল। এই রহস্যটি প্রকাশের লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। ক্ষমা করবেন। ময়মনসিংহের ইতিহাসে এটিও স্থান পাবার দাবি রাখে বৈকি?
ময়মনসিংহ শহর ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রাণকেন্দ্র। আজ আদি ময়ননসিংহ জেলা খণ্ডবিখণ্ড। টাঙ্গাইল মহকুমা জেলারূপে আত্মপ্রকাশ করে ১ ডিসেম্বর ১৯৬৯ তারিখে। জামালপুর পৃথক হয়ে যায় ৪ জানুয়ারি ১৯৭৮ সালে। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা পৃথক হয় ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪-তে। জন্ম নিয়েছে পাঁচটি নতুন জেলা সদর কেন্দ্র। ভুললে চলবে না যে এই পাঁচটি জেলা সদরের মা হল ময়মনসিংহ শহর। ময়মনসিংহ শহরের সঙ্গে এদের নাড়ীর সম্পর্ক।
রচনাটি খুবই সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত। কারণ, এটি তাড়াহুড়া করে লেখা হয়েছিল সেমিনারে পঠিত হবে বলে। সেমিনারের আহবায়ক সময়ের কথাও বলে দিয়েছিলেন পূর্বাহ্ণে। যাহোক, এই পুস্তিকার সূত্র ধরে আশা করি ভবিষ্যতে অন্য কেউ ময়মনসিংহ শহরের বৃহৎ ইতিহাস রচনায় হাত দেবেন। এই আশা রেখে এখানেই শেষ করছি।
সংস্কৃতিমনস্ক অনুসন্ধিৎসু একজন মানুষ। ছাত্রাবস্থায় বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন বহু পুরস্কার। ১৯৯২ সালে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অর্জন করেছেন জাতীয় পুরস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ‘পলল প্রকাশনী’। বহুমাত্রিক লেখালেখি থাকলেও তিনি প্রকাশনা ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক লেখালেখিতে অধিক আগ্রহী। রচিত গ্রন্থ : বইমেলা ও বই সংস্কৃতি, বই, বইমেলা ও প্রকাশনার কথকতা, টাঙ্গাইল জেলা পরিচিতি, টাঙ্গাইলের অজানা ইতিহাস, জানা-অজানা মালয়েশিয়া, পথে দেখা বাংলাদেশ ইত্যাদি পাঠক মহলে সমাদৃত। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে তিনি একজন নেতৃস্থানীয় সংগঠক। বই, বই প্রকাশনা ও বইমেলা সংক্রান্ত জাতীয় আয়োজনের বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে খান মাহবুবের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ’ বিভাগ চালুর অন্যতম উদ্যোগী তিনি। বর্তমানে বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। লেখকদের সংগঠন ‘লেখক সম্প্রীতি’র মহাসচিব তিনি। ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী সাহানা মাহবুব, তাঁদের দু’কন্যা তানিসা মাহবুব ও লহরি নহর মাহবুব। ১৯৭১-এর ৩ মে নানাবাড়ি টাঙ্গাইলের করাতিপাড়ার সৈয়দ বাড়িতে জন্ম। পৈতৃক নিবাস কালিহাতী উপজেলার রাজাফৈর গ্রামে। বাবা স্বনামধন্য আইনজীবী মো. মোশারফ হোসেন, মা সৈয়দা জহুরা আখতার।