রাসূল এলেন মদীনায়
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এক অনন্য ব্যক্তিত্বের নাম। যিনি একাধারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী ছিলেন। সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য ছিলেন রহমত স্বরূপ। ছিলেন ইলম ও আমলের কেন্দ্রবিন্দু, সমগ্র মানবজাতির সর্বপ্রধান উস্তাদ।
মানবিক সকল গুণের অপূর্ব ভাÐার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরণের আরো হাজারো বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি ছিলেন একজন মহান রাষ্ট্রপ্রধান, বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক। যুদ্ধের ময়দানের বিচক্ষণ সেনাপতি, দূরদর্শী কমান্ডার। দয়া ও রহমতের নবী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন নবীউস সাইফ, নবীউল মালাহিম (তথা তরবারী ও বর্শাধারী নবী)ও।
কিন্তু দু:খ ও আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমানে আমরা কেবল নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ‘রহমতের’ নবী হওয়া আর ‘দয়ার সাগর’ হওয়ার বিষয়টি নিয়েই আলোচনা-পর্যালোচনা করি। রাসূলের পথে কাঁটা বিছিয়ে দেয়া মহিলার সেবা-শুশ্রæষায় প্রিয়নবীর ভূমিকা তুলে ধরি। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করতে এসে ধরা পরে যাওয়া কাফিরের উপর প্রিয়নবীর ক্ষমাবাণী ঘোষণার কথাই কেবল প্রচার করি।
কিন্তু এই একই মহান রাসূলের ব্যক্তি ও পারিবারিক বিষয়াবলীর পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যেই বিশাল ও বিস্তৃত জগত, যেখানে তাঁর মূল্যবান সময়, মেধা ও শ্রমগুলো ব্যয় হয়েছে। যেই দূরদর্শী আদর্শিক রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্তাবলী কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ববাসীর জন্য অনন্য পাথেয় হয়ে আছে, সেই বিষয়গুলোর প্রতি আমরা কেনো যেনো দৃষ্টি দিতে চাই না। আর যুদ্ধ-জিহাদের বিষয় তো আরো অবহেলিত। যুদ্ধের ময়দানে শত্রæর ঔদ্ধ্যত খোলা তরবারীর সামনে বুকটান করে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনী পরিচালনায় রাসূলের সেই নিপূণ দক্ষতার কথা, চতুর্দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পরা অগণিত শত্রæবাহিনীর সামনে -সাথের লোকজন পিছু হটে যাওয়া সত্তে¡ও- বীর পুরুষের মতো অটল-অবিচল থাকা এবং “আমি সত্য নবী মিথ্যা নবী নই; আমি আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর কাপুরুষ নই।” বলে সিংহের গর্জন দিয়ে সামনে বাড়ার সেই পৌরুষদীপ্ত সোনালী মুহূর্তগুলোর অবিস্মরণীয় ঘটনাগুলোর কথা আলোচনা করি না। তার যথাযথ শব্দ চিত্রায়নে এগিয়ে আসি না। আর সে অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা তো আরো পরের কথা।
আসলে লজ্জাজনক সত্য ও তিক্ত বাস্তবতা হলো, আমরা রাসূলের দয়ার্দ্রতা ও ক্ষমাবাণীর সাইনবোর্ড উঁচিয়ে তার পেছনে নিজেদের ভীরু-কাপুরুষতা ও লজ্জাস্কর দূর্বলতাকে আড়াল করতে সচেষ্ট হই। নিজেদের অক্ষমতাকে শ্রেষ্ঠত্ব মনে করে আনন্দ পাই। রাসূলের দয়া ও ক্ষমার ঘটনাবলীর মধ্যে নিজেদের কাপুরুষতার দলীল খুঁজি। না হয় কেন আমরা ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জিহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কিত প্রিয় রাসূলের সমৃদ্ধ জীবনীর সেই অবিস্মরণীয় অধ্যায়গুলো বারবার এড়িয়ে যাবো?
অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত পরবর্তী তাঁর মাদানী যিন্দেগীর গুরুত্বপূর্ণ দশ বছরের প্রায় পূর্ণ সময়টিই রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও নিরাপত্তাকে সুসংহত করার জন্য জিহাদের কাজে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস স্বশরীরে অবস্থান করেছেন রণাঙ্গনে।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত অধ্যয়ন করলে হতবাক হয়ে যেতে হয় যে কিভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হিজরত পরবর্তী সময়গুলো অতিবাহিত করেছেন। মদীনায় আসার পর থেকে নিয়ে ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত রাসূলের জীবনের এমন একটি দিনও অতিবাহিত হয়নি, যেদিন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফিরদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলেন। এমন কোনো রাত অতিক্রান্ত হয়নি, যাতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্ভাবনায় শান্তিতে ঘুমিয়েছেন। বরং মদীনায় এসে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না করতেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতে পেলেন যে, তাঁর চারিদিকে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের নিশ্চিদ্র জাল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। মক্কার মুশরিক, মদীনার ইহুদী আর মুসলমান নামধারী মুনাফিক -এই তিন শক্তি গোপনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই এবার বাধ্য হয়ে দয়া ও রহমতের নবী, রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুদরতী ইশারায় নিজ তরবারীতে শান দেয়া আরম্ভ করলেন। মহান আল্লাহর অনুমোদন ও নির্দেশ পেয়ে জিহাদের আমল শুরু করলেন।
এরপরের ইতিহাস একদিকে যেমনি রোমাঞ্চকর, অপরদিকে তেমনি বেদনাবিধূর। ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বকে রক্ষার জন্য এরপর থেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমরণ জিহাদ করতে হয়েছে। চালাতে হয়েছে অসংখ্য অভিযান। প্রতিটি রণক্ষেত্রে রাখতে হয়েছে জীবনবাজি। নিজ দেহের পবিত্র খুন ঝরাতে হয়েছে। ছুটে যেতে হয়েছে কখনও বদরে, কখনও ওহুদে। কখনও হুনাইন প্রান্তরে কিংবা তায়েফের রণক্ষেত্রে। আবার কখনও দূর্গম গিরি, কান্তার মরু, পাথুরে জমিন পারি দিয়ে যেতে হয়েছে শত শত মাইল দূরবর্তী তাবুকে। খোলা আসমানের নিচে উত্তপ্ত মরুভূমিতে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন, সপ্তাহর পর সপ্তাহ।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদীনায় আসার পর থেকে এই যুদ্ধ-জিহাদের কাজে এমনভাবে ব্যাপৃত হন, এমনভাবে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করতে থাকেন, যা বর্তমান যুগের সমরকুশলী সেনানায়কদের জন্য বিস্ময়কর ও দুর্বোধ্য এক কঠিন অধ্যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মদীনার মাত্র দশ বছরের জীবনে স্বয়ং ২৭ টি যুদ্ধের সেনাপতিত্ব করেছেন। ৭৪ টি সেনাদল বিভিন্ন সাহাবীর নেতৃত্বে প্রেরণ করেছেন। এমন কি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকালের পূর্ব মুহূর্তেও হযরত উসামা বিন জায়েদ রা. এর নেতৃত্বে জিহাদের জন্য সেনাদল প্রেরণ করেছেন। অর্থাৎ রাসূলের জীবনের সর্বশেষ কাজ ছিলো হযরত উসামা রা. এর হাতে জিহাদের ঝান্ডা তুলে দেয়া।
কিন্তু এতদসত্তে¡ও বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজে এমন কিছু আধুনিক (?) মুসলিমদের হাক-ডাক শোনা যাচ্ছে, যারা নিজেদেরকে সেক্যুলার পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। ইসলামকে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ইসলামী শরীয়া সম্পর্কে জনমনে ভুল ধারণা দেয়া এবং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আমল জিহাদ সম্পর্কে সমাজে বিরূপ প্রচারণা চালানোকেই তারা তাদের মূল এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। রাসূলের জীবনীকেও তারা নিজেদের মন মতো বিকৃত করছেন। এভাবে তারা ইসলামকে নিছক আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব একটি ধর্মে সীমাবদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন।
এই অবস্থায় ইসলামের সত্যিকার স্বরূপ জনসম্মক্ষে তুলে ধরার জন্য, ইসলামের সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাস, ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং জিহাদ ইত্যাদি বিষয়ের উপর গবেষণাধর্মী ব্যাপক কাজ হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনীর সঠিক চিত্রায়ন এবং সীরাতের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারও খুবই জরুরী একটি কাজ। এই মহান কাজে সামান্য ভূমিকা রাখার লক্ষ্যেই এই গ্রন্থের অবতারণা। এটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিজরত পরবর্তী মাদানী জীবনীর উপর ভিত্তি করে রচিত সিরীজ ‘সীরাতে মদীনা’ এর প্রথম খন্ড। আশা করি ৫-৬ খন্ডে এটি সমাপ্ত হবে। এই সীরীজের মধ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাদীনী জীবন এবং তাতে অন্যান্য বিষয়ের মতো ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, ইসলামী শরীয়া এবং জিহাদের ক্ষেত্রে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভূমিকাও যথাযথভাবে তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ।
যেহেতু এটি সীরাত বিষয়ক গ্রন্থ, তাই এটি রচনার ক্ষেত্রে সীরাতের নির্ভরযোগ্য অনেকগুলো বই থেকে উদ্ধৃতি ও সহায়তা নেয়া হয়েছে এবং এক বিষয়ে একাধিক মতামতের মধ্য হতে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মতটিই সংক্ষেপে এতে তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত অধ্যয়নের ক্ষেত্রে আগ্রহী পাঠকদের জন্য এটি একটি ভিন্ন আবহ তৈরী করতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবূল করুন। আমাদের সকলকে তাঁর দ্বীনের প্রয়োজন পূরণের উসীলা হিসেবে কবূল করুন। আমীন।