পোল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো ওয়াওয়েল রয়েল ক্যাসেল। এটি μাকো শহরের ভিস্টুলা নদীর তীরে ওয়াওয়েল হিলের উপর অবস্থিত। ক্যাসেলের পেছনে নদীর পাড় বেয়ে আঁকাবাঁকা পিচঢালা রাস্তা মাড়িয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়াই। রাস্তায় হাঁটা পথে মার্বেল পাথরে হাতের ছাপসহ বেশ কয়েকটি নামফলক দেখলাম। আমার চোখ আটকালো ‘অমিতাভ বচ্চন ২০১১’ ফলকটি দেখে। এমন বিশ্বখ্যাত প্রায় আট-দশজন ব্যক্তির হাতের ছাপের নামফলক কিছুটা দূরত্ব রেখে সাঁটানো। সাধারণ পথচারী হাতের ছাপের নামফলক মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম বিশ্বখ্যাত মানুষগুলো রয়েল ক্যাসেল পরিদর্শনে এসেছিলেন। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতেই এই সুন্দর আয়োজন।
একজন বিশ্বব্যক্তিত্ব হিসেবে অমিতাভ বচ্চনের স্মৃতিফলক বিশ্বের যেকোনো দেশে থাকতেই পারে। কিন্তু খ্যাতিমান নাট্যকার, নাট্য-পরিচালক, চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতা আবদুল্লাহ আল মামুন বাংলৎাদেশের একজন কিংবদন্তি জাতীয় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাঁর স্মৃতিচিহ্ন রাখতে পারিনিÑ এ আমাদের ব্যর্থতা। জন্মই মানুষের চলে যাওয়ার নিশ্চয়তা, যেতে তাকে হবেই, এটাই নিয়তি। মানুষ চলে গেলেও থেকে যায় তার কাজ, অনাদিকাল। বাংলাদেশ পেয়েছিল বিশ্বমানের তেমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ আবদুল্লাহ আল মামুনকে।
বাংলাদেশের কিংবদন্তি নাট্যকার, কথাশিল্পী, নাট্য নির্দেশক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা আবদুল্লাহ আল মামুন। এ দেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটকে নানাভাবে, নানামাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচারের উত্থান, দুর্নীতি, সামাজিক ও পারিবারিক অসঙ্গতি চমৎকার জীবন্ত হয়ে উঠেছে আবদুল্লাহ আল মামুনের মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে। তাঁর নাটকে মুক্তিযুদ্ধ, সমকালীন রাজনীতি ও সমাজ-বাস্তবতা বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে। তিনি নাটকে নানাভাবে ও নানা অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতা। তিনি নাটকের মাধ্যমে তাঁর দর্শকদের আত্ম-সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাপ্রাপ্তি বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায়। তাঁর রচনায় মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান শোনা যায়।
বোহেমিয়ান লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুন প্রায় চার দশক ইয়োরোপ প্রবাসী। বর্তমানে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের নিকটবর্তী নয়ে-ইজেনবুর্গ শহরে থাকেন। জন্ম ১৯৪৫ সালে, রাজশাহীতে। বেড়ে উঠেছেন জামালপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ শেষ করে '৬৮ সালে পাবনার একটি কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু। '৭৭ সাল অবধি কখনো আমলা, কখনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা। '৭৭ সালের অক্টোবরে দেশত্যাগ, প্রথমে গ্রিস তারপর জার্মানি। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থনা মঞ্জুর ৮৫ সালে। '৯৩ সালে পান জার্মানির নাগরিকত্ব। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে চলে যান সুইজারল্যান্ড। সেখানে তিনি অ্যাঙ্গেলবার্গের একটি হোটেলে এবং পরে দাভোজের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাত তারা হোটেল গ্র্যান্ড স্টাইগেনবার্গার বেলভেদ্রেতে চাকরি নেন। সেখানে তিনি বিল ক্লিন্টন, নেলসন ম্যান্ডেলা, কফি আনান, পিটার উস্তিনভ, পল ম্যাকার্টনি, ম্যাডোনা, রোমান পোলানস্কি, বিল গেটস, টনি ব্লেয়ার, প্রিন্স চার্লস প্রমুখ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। জার্মানিতে ফিরে আসেন ২০০৫ সালে। বিচিত্র ও চমকপ্রদ এসব অভিজ্ঞতা তার লেখার অনুপ্রেরণা। মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ সময়ে সঙ্গ দেয়ার ইয়োরোপিয়ান সংগঠন হজপিসের সক্রিয় সদস্য তিনি। সুযোগ পেলেই সানন্দে মৃত্যুসঙ্গ দেন। মৃত্যুসঙ্গ ও মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন চারটি বই- জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন, মৃত্যু: একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা এবং মৃত্যুসঙ্গীর দিনলিপি। ২০০৮ সালের একুশে বইমেলায় প্রথম বই- প্রবাসে দৈবের বশে'র প্রকাশ উপলক্ষে দেশে এসেছিলেন দেশত্যাগের ত্রিশবছর পর। ২০১০ সালের নভেম্বরে অবসর জীবনের শুরু। সময় পেলে অনুবাদও করে থাকেন। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়, বড় ভাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যজন প্রয়াত আবদুল্লাহ আল-মামুন।