ফ্ল্যাপে লিখা কথা এশিয়া মহাদেশ থেকে সর্বপ্রথম যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন তাঁর বয়স মাত্র বাহান্ন বছর। এরপর আরো প্রায় তিরিশ বছরের মতো বেঁচে থাকবেন। দশ বছর বয়সে থেকে লেখালেখি শুরু, সত্তর বৎসর ধরে একটুও না থেমে বিরতীহীন ক্রমাগত লিখে যাবেন: কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক নৃত্যনাট্য গান গীতিনাট্য কী নয়! বিভিন্ন জনকে লেখা চিঠিপত্রের সংক্যাও সহস্রাধিক। এর ওপর রয়েছে ছবি আঁকা।নিজের গানের সুর নিজেই দিয়েছেন,সকলকে গেয়ে শুনিয়েছেন। তার গানে গলা এতই সুরেলা ছিল যে তাঁর যৌবন কালে বিশাল সব সভাসমিতিতে গান গেয়ে শোনাবার জন্য ডাক পড়ত! জীবনে যেন তাঁর বিশ্রাম ছিল না, ক্রমাগত একের পর এক কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তা ঘটত কখনও নিজেরই ভিতরের তাগিদে,কখনও আবার সমাজের নানান দায়িত্বপালনের কারণে। এত ব্যস্ততার চাপ! দেখলে যেন মনে হয় ,রবীন্দ্রনাথ নামে এই মানুষটির যেন কোনো শৈশব-কৈশোর ইত্যাদি কিছুই ছিল না। ছিল বৈকি! নিশ্চয় ছিল। পাছে আমরা ভুল করি কিংবা ভুলে যাই তাই তিনি নিজেই লেখে গেলেন ‘ছেলেবেলা’। বুড়ো বয়সে পৌঁছে গিয়ে সেখান থেকে পিছন পানে ফিরে তাকিয়ে দেখা। তাঁর ছেলেবেলা মানে তো দেড় শ’ বছর পিছনের ব্যাপার। সে এক ভিন্ন সময়,ভিন্ন যুগ। আজকের কালের সঙ্গে তার কিছুই মিলবে না। কিন্তু সে কালতো চিরকালের বাঙালি জীবনের একটা অংশ ,তাই সেটাও না জানলে চলবে কেন? রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ বইটির গুরুত্ব এইখানেই। ‘ছেলেবেলা’র বর্তমান সংস্করণটির মাহাত্ন্য এই যে, পশ্চিমবঙ্গ বা এদেশ থেকে কবিগুরুকে আদ্যোপান্ত চিনিয়ে দেওয়ার উপযোগী এ ধরনের প্রামাণ্য চিত্রশোভিত আর কোনো বই ইত:পূর্বে প্রকাশিত হয় নি। এদিক থেকে এই ‘ছেলেবেলা’ অনন্য।
ভূমিকা গোঁসাইজির কাছ থেকে অনুরোধ এল ছেলেদের জন্যে কিছু লিখি। ভাবলুম, ছেলেমানুষ রবীন্দ্রনাথের কথা লেখা যাক। চেষ্টা করলুম সেই অতীতের প্রেকলোকে প্রবেশ করতে। এখনকার সঙ্গে তার অন্তরবাহিরের মাপ মেলে না। তখনকার প্রদীপে যত ছিল আলো তার চেয়ে ধোঁওয়া ছিল বেশি। বুদ্ধির এলাকায় তখন বৈজ্ঞানিক সার্ভে আরম্ভ হয় নি, সম্ভব-অসম্ভবের সীমারহদ্দের চিহৃ ছিল পরস্পর জড়ানো। সেই সময়টুকুর বিবরণ যে ভাষায় গেঁথেছি সে স্বভাবতই হয়েছে সহজ, যথাসম্ভব ছেলেদেরই ভাবনার উপযুক্ত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমানুষি কল্পনাজাল মন থেকে কুয়াশার মতো যখন কেটে যেতে লাগল তখনকার কালের বর্ণনার ভাষা বদল করি নি,কিন্তু ভাবটা আপনিই শৈশবকে ছাড়িয়ে গেছে। এই বিবরণটিকে ছেলেবেলাকার সীমা অতিক্রম করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু শেষ কালে এই স্মৃতি কিশোর-বয়সের মুখোমুখি এসে পৌঁছেছে। সেই খানে একবার স্থির হয়ে দাঁড়ালে বোঝা যাবে কেমন করে বালকের মন:প্রকৃতি বিচিত্র পারিপাশ্র্বিকের আকস্মিক এবং অপরিহার্য সমবায়ে ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠেছে। সমস্ত বিবরণটাকেই ছেলেবেলা আখ্যা দেওয়ার বিশেষ সার্থকতা এই যে ,ছেলেমানুষের বৃদ্ধি তার প্রাণশক্তির বৃদ্ধি। জীবনের আদি পর্বে প্রধানত সেইটেরই পতি অনুসরণযোগ্য। যে পোষণপদার্থ তার প্রাণের সঙ্গে আপনি মেলে বালক তাই চারি দিক থেকে সহজে আত্নসাৎ করে চলে এসেছে। প্রচলিত শিক্ষাপ্রণালী -দ্বারা তাকে মানুষ করবার চেষ্টাকে সে মেসে নিয়েছে অতি সামান্য পরিমানেই। এই বইটির বিষয়বস্তুর কিছু কিছু অংশ পাওয়া যাবে জীবন স্মৃতিতে ,কিন্তু তার স্বাদ আলদা সরোবরের সঙ্গে ঝরণার তফাতের মতো। সে হল কাহিনী। ,এ হল কাকলী: সেটা দেখা দিচ্ছে ঝুড়িতে, এটা দেখা দিচ্ছে গাছে। ফলের সঙ্গে চার দিকের ডালপালাকে মিলিয়ে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। কিছুকাল হল একটা কবিতার বইয়ের কিছু কিছু চেহারা দেখা দিয়েছিল,সেটা পদ্যের ফিলমে । বইটার নাম ‘ছড়ার ছবি’। তাতে বকুনি ছিল কিছু কাল নাবালকের,কিছু সাবালাকের। তাতে খুশির প্রকাশ ছিল অনেকটাই ছেলেমানুষি খেয়ালের। এ বইটাতে বালভাষিত গদ্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।