"লাল সালু" সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচিত একটি কালজয়ী বাংলা উপন্যাস, যা ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে গ্রামীণ সমাজ, ধর্মীয় কুসংস্কার, লোকাচার এবং মানুষের বিশ্বাসের রাজনীতিকে গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
📘 সারমর্ম (সারসংক্ষেপ):
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মজিদ, একজন সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি। সে শহর থেকে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে এসে নিজেকে ধর্মজ্ঞ ও পীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সে গ্রামে একটি পরিত্যক্ত কবরকে "ওলি আউলিয়ার মাজার" বলে ঘোষণা দেয় এবং সেখানে একটি লাল সালু (লাল কাপড়) বিছিয়ে দেয়—এটাই উপন্যাসের নামের উৎস।
মজিদ গ্রামের সাধারণ মানুষদের ধর্মের ভয় দেখিয়ে ও ভ্রান্ত বিশ্বাসে আচ্ছন্ন করে নিজের আধিপত্য গড়ে তোলে। সে গ্রামে নানা কুসংস্কার তৈরি করে, ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং তার কথাই যেন আল্লাহর আদেশ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গ্রামের সহজ-সরল মানুষরা মজিদের কথায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে।
উপন্যাসের পরিণতিতে দেখা যায়, মজিদের নিজের বিশ্বাসেও টান পড়ে। নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব, ভয়ের প্রভাব এবং মিথ্যার ভারে সে নিজেই এক মানসিক অস্থিরতায় ভোগে।
🎯 মূল বিষয়বস্তু:
ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা লাভ
গ্রামীণ জীবনের সরলতা ও কুসংস্কারের ভয়াবহতা
আত্মপ্রবঞ্চনা ও সমাজে মিথ্যার প্রতিষ্ঠা
ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংকট
📚 উপন্যাসটির গুরুত্ব:
"লাল সালু" বাংলা সাহিত্যে আধুনিক উপন্যাসের একটি মাইলফলক। এটি শুধু ধর্মীয় প্রতারণা নয়, বরং মানুষের বিশ্বাস, ভয়ের মনস্তত্ত্ব ও সমাজব্যবস্থাকে গভীরভাবে তুলে ধরে। উপন্যাসটি একদিকে যেমন সামাজিক সমালোচনা, অন্যদিকে তেমনি এক নিখুঁত মনস্তাত্ত্বিক চিত্রণ।
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।