ভূমিকা এলার মনে পড়ে তার জীবনের প্রথম সূচনা বিদ্রোহের মধ্যে। তার মা মায়ময়ীর ছিল বাতিকের ধাত, তাঁর ব্যবহারটাই বিচার-বিবেচনার প্রশস্ত পথ ধরে চলতে পারতো না। বেহিসাবি মেজাজের অষংযত ঝাপটা সংসারকে তিনি যখন-তখন ক্ষুব্ধ করে তুলতেন,শাসন করতেন অন্যায় করে, সন্দেহ করতেন অকারনে। মেয়ে যখন অপরাধ অস্বীকার করতো,ফস্,করে বলতেন,মিথ্যে কথা বলছিস। অথচ অবিমিশ্র সত্য –কথা বলা মেয়ের একটা ব্যসন বললেই হয়। এজন্যেই সে শান্তি পেয়েছি সব চেয়ে বেশি।সকল রকম অবিচারের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা তার স্বভাবে প্রবল হয়ে উঠেছে। তার মার কাছে মনে হয়েছে, এইটেই স্ত্রীধর্ম নীতির বিরুদ্ধ। একটা কথা সে বাল্যকাল থেকেই বুঝেছে যে, দুর্বলতা অত্যাচারের প্রধান বাহন। ওদের পরিবারে যে-সকল অশ্রিত অন্নজীবি ছিল ,যারা পরের অনুগ্রহ-নিগ্রহের সংকীর্ণ্ বেড়াদেয়া ক্ষেত্রের মধ্যে নিঃসহায়ভাবে আবদ্ধ, তারাই কলুষিত করেছে ওদের পরিবারের আবহাওয়াকে, তারাই ওর মায়ের অন্ধ প্রভুত্বচর্চাকে বাধাবিহীন করে তুলেছে।এ অস্বাস্থ্যকর অবস্থার প্রতিক্রিয়ারুপেই ওর মনে অল্প বয়স থেকেই স্বাধীনতার আকাঙ্খা এত দুর্দাম হয়ে উঠেছিল। এলার বাপ নরেশ দাশগুপ্ত সাইকোলজিতে বিলিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন।তীক্ষ্ণ তাঁর বৈজ্ঞানিক বিচার শক্তি,অধ্যাপনায় তিনি বিশেষভাবে যশস্বী।প্রাদেশিক প্রাইভেট কলেজে তিনি স্থান নিয়েছেন, যেহেতু সেই দেশেই তাঁর জন্ম, সাংসারিক উন্নতির দিকে তাঁর লোভ কম,সে সম্বদ্ধে দক্ষতাও সামান্য। ভুল করে কোন লোককে বিশ্বাস করা ও বিশ্বাস করে নিজের ক্ষতি করা, বারবারকার অভিজ্ঞতাতেও তাঁর শোধন হয়নি। ঠকিয়ে কিংবা অনায়াসে যারা উপকার আদায় করে তাদের কৃতঘ্নতা সব চেয়ে অকরুন। যখন সেটা প্রকাশ পেত সেটাক মনস্তত্বের বিশেষ তথ্য বলে মানুষটি অনায়াসে স্বীকার করে নিতেন, মনে বা মুখে নালিশ করতেন না। বিষয় বুদ্ধির ত্রুটি নিয়ে স্ত্রীর কাছে কখনও ক্ষমা পাননি।, খোটা খেয়েছেন তিনি। নালিশের কারণে অতীতকালবর্তী হলেও তাঁর স্ত্রী কখনো ভুলিতে পারতেন না, যখন –তখন তীক্ষ্ণ খোঁছায় উসকিয়ে দিতে তার দাহ কে ঠান্ডা হতে দেওয়া অসাধ্য করে তুলতেন। বিশ্বাসপরায়ণ ঔদার্য-গুনেই তাঁর বাপকে কেবলই ঠকতে ও দুঃখ পেতে দেখে বাপের উপর এলার ছিল সদাব্যথিত স্নেহ-যেমন সকরুন স্নেহ মায়ের থাকে অবুঝ বালকের ‘পরে। সব চেয়ে তাকে আঘাত করতো যখন মায়ের কলহের ভাষায় তীব্র ইঙ্গিত থাকত যে,বুদ্ধিবিবেচনায় তাঁর স্বামীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এলা নানা উপলক্ষে মায়ের কাছে তাঁর বাবার অসম্মান দেখতে পেয়েছে, তা নিয়ে নিষ্ফল আক্রোশে চোখের জলে রাত্রে তার বালিশ গেছে ভিজে। এরকম অতিমাত্র ধৈর্য অন্যায় বলে এলা অনেক সময় তার বাবকে মনে মনে অপরাধী না করে থাকতে পারে নি। অত্যন্ত পীড়িত হয়ে একদিন এলা বাবাকে বলেছিল,“এরকম অন্যায় চুপ করে সহ্য করাই অন্যায়”। নরেশ বললেন,“স্বভাবের প্রতিবাদ কারও যা আর তপ্ত লোহায় হাত বুলিয়ে তাকে ঠান্ডা করতে পাওয়াই তাই, তাতে বীরত্ব থাকতে পারে কিন্তু আরাম নেই।” “চুপ করে থাকাতে আরাম আরো কম”-বলে এলা দ্রুত চলে গেল। এদিকে সংসারে এলা দেখতে পায়, যারা মায়ের মন জুগিয়ে চলবার কৌশল জানে তাদের চক্রান্তে-নিষ্ঠুর অন্যায় ঘটে অপরাধহীনের প্রতি। এলা সইতে পারে না, উত্তেজিত হয়ে সত্য প্রমাণ উপস্থিত করে বিচার কত্রীর সামনে। কিন্তু কর্তৃত্বের অহবিকার কাছে অকাট্য যুক্তিই সুঃসহ স্পর্ধা। অনুকূল ঝোড়ো হাওয়ার মতো তাতে বিচারের নৌকা এগিয়ে দেয় না, নৌকা দেয় কাত করে। এই পরিবারে আরো একটি উপসর্গ ছিল যা এলার মন কে নিয়ত আঘাত করেছে। সে তার মায়ের সচিবায়ু। একদিন কোনো মুসলমান অভ্যাগতকে বসবার জন্যে এলা মাদুর পেতে দিয়েছিল-সে মাদুর মা ফেলে দিলেন। গালচে দিলে দোষ হতো না। এলার তার্কিক মন, তর্ক না করে থাকতে পারে না। বাবাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলে,“আচ্ছা, এই সব ছোঁয়াছুয়ি নাওয়াখাওয়া নিয়ে কটকেনা মেয়েদেরই কেন এত পেয়ে বসে। এতে হৃদয়ের তো স্থান নেই, বরং বিরুদ্ধতা আছে, এ তো কেবল যন্ত্রের মতো অন্ধভাবে মেনে চলা। সাইকোলজিষ্ট বাবা বললেন,“মেয়েদের হাজার বছরের হাতকড়ি-লাগানো মন; তারা মানবে, প্রশ্ন করবে না-এইটেতে সমাজ-মনিবের কাছে বকশিশ পেয়েছে, সেই জন্য মানাটা যত বেশি অন্ধ হয় তার দাম তাদের কাছে তত বড় হয়ে ওঠে। মেয়েলি পুরুদেরও এই দশা।” আচারের নিরর্থকতা সম্বন্ধে এলা বার বার মাকে প্রশ্ন না করে থাকতে পারে নি, বার বার তার উত্তর পেয়েছে ভৎসনায়। নিয়ত এই ধাক্কায় এলার মন অবাধ্যকতার দিকে ঝুকে পড়েছে । নরেশ দেখলেন পাবিবারিক এই-সব দ্বন্দে মেয়ের শরীর খারাপ হয়ে উঠেছে, নেটা তাঁকে অত্যন্ত বাজল। এমন সময় একদিন এলা একটি বিশেষ অবিচারে কঠোর ভাবে আহত হয়ে নরেশের কাছে এসে জানাল,“বাবা, আমাকে কলকাতায় বোর্ডিঙে পাঠাও।” প্রস্তাবটা তাদের দুজনের পক্ষেই দুঃখকর, কিন্তু বাপ অবস্থা বুঝলেন এবং মায়ময়ীর দিক থেকে প্রতিকূল ঝনঝাঘাতের মধ্যেও এলাকে পাঠিয়ে দিলেন দূরে। আপন নিষ্করণ সংসারে নিমগ্ন হয়ে রইলেন অধ্যয়ন-অধ্যাপনায়। মা বললেন “শহরে পাঠিয়ে মেয়েকে মেম সাহেব বানাতে চাও তো বানাও, কিন্তু ঐ তোমার আদুরে মেয়েকে প্রাণান্ত ভুগতে হবে শ্বশুর ঘর করবার দিনে। তখন আমাকে দোষ দিয়ো না।” মেয়ের ব্যবহারে কলিকালোচিত স্বাতন্ত্র্যর দুর্লক্ষণ দেখে এই আশঙ্কা তার মা বার বার প্রকাশ করেছেন। এলা তার ভাবী শ্বাশুড়ির হাড় জ্বালাতন করবে সেই সম্ভাবনা নিশ্চিত জেনে সেই কাল্পনিক গৃহিণীর প্রতি তাঁর অনুকম্পা মুখর হয়ে উঠত। এর থেকে মেয়ের মনে ধারনা দৃঢ় হয়েছিল যে, বিয়ের জন্যে মেয়েদের প্রস্তুত হতে হয় আত্নসম্মানকে পঙ্গু করে, ন্যায়-অন্যায়-বোধকে অসাড় করে দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।