ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান নামক দেশটি সৃষ্টি হয়েছিলো। এরমধ্যে ধর্ম ও ধর্মের পক্ষে বিপক্ষে সক্রিয় ছিলো নানা মতাদর্শের রাজনৈতিক পার্টি। রাজনৈতিক পার্টি সৃষ্টির নেপথ্যে নানা কারণ থাকে। মূলত একটি সক্রিয় পার্টির নেতা কর্মীদের মধ্যে যখন ব্যক্তি বা বৃহত্তর ইস্যু নিয়ে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয় তখন এদের মধ্য থেকেই একটি অংশ নতুন কোনো পার্টি গঠন করে। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ বা গবেষণা করলে দেখা যাবে যে, সেসব দেশের রাজনৈতিক পার্টিগুলোর মধ্যে দুই চারটি পার্টিই সম্মুখ ভূমিকা পালন করে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে। এর বাইরে নামসর্বস্ব নানা রকম পার্টি থাকে। এদের ভূমিকা খুব একটা না থাকলেও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে এসব পার্টি চলমান রাখে। শামিমা আকতার লিপি একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞানে শিক্ষক। তিনি পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে। সে সুবাদে তিনি রাষ্ট্রের ইতিহাস ও রাজনৈতিক পার্টির ইতিহাস সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান রাখেন। এছাড়া তিনি বড় হয়েছে রাজনৈতিক পরিবারে। তিনি তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন ‘বাংলাদেশে ভাসানী ন্যাপের রাজনীতি’। স্বাধীনতার পূর্বে এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এ পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বিশদ ও বিপুল তথ্য উপাত্ত সমৃদ্ধ গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণাপত্রকেই বই হিসেবে একাডেমির বাইরে বৃহৎ পাঠক সমাজের কাছে উন্মুক্ত করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একজন ঐতিহাসিক ও অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮৫-১৯৭৬)। তিনি ১৯০৭ সালে ‘রেশমি রুমাল’ আন্দোলোন থেকে ১৯৭৬ সালের ফারাক্কা লং মার্চ আন্দোলন পর্যন্ত উপমাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সাথে জড়িত ছিলেন ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার রাজনীতির অন্যতম একটি জায়গা ছিলো সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধীতা। তিনি নানা সময় নানা রকম রাজনীতির দল, মত ও আদর্শের পরিবর্তন করেছেন। তার ভাষ্য মতে- ‘আর্দশের থেকে মানুষ বড়’ তাই তিনি আমৃত্যু মানুষের পাশে থেকে মানুষের জন্য লড়াই করেছেন অকুতভয়ে। পাকিস্তানের মুসলীম লীগ সরকার জনগণকে যে প্রতিশ্রæতি দিয়ে শাসন ক্ষমতায় এসেছিল তা পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানীসহ আরও অনেক নেতা মুসলীম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এরপর আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠন করেন। কিন্তু আওয়ামী মুসলীম লীগের অন্যতম নেতা সোহ্রাওয়ার্দী মার্কিনঘেঁষা নীতি অবলম্বন করলে মওলানা ভাসানী আওয়ামী মুসলীম লীগ ত্যাগ করে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পাটির্’ নামে নতুন একটি পার্টি গঠন করেন। এ পার্টির সংক্ষিপ্ত নাম ন্যাপ। শামিমা আকতার লিপি ন্যাপের যাবতীয় কার্যক্রম ও এদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন বইটিতে। বইটিতে রয়েছে সাতটি অধ্যায়। ৩০৪ পৃষ্টার এ বইটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও এর বিকাশ সম্পর্কে জানতে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে রাজনীতি মনস্ক পাঠকদের জন্য খুবই সহায়ক হবে। এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো বইমেলা ২০১৩ সালে। বর্তমান সময়ের যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চলছে তার পেছনের ইতিহাসের যে প্রভাব তা বুঝতে বইটি কর্যকারী হবে নিঃসন্দেহে।
ড. শামিমা আকতার লিপি—একাধারে কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক। সত্তরের দশকের শেষভাগে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের শিকড় নওগাঁ জেলার মান্দা থানার দোসতিনা গ্রামে। তার পিতা এ্যাডভোকেট অহিদ উদ্দিন মণ্ডল এবং মাতা সুফিয়া অহিদ—শিক্ষা ও মননের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেওয়া লিপি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যসাধনার সাথে যুক্ত ছিলেন, এবং আমৃত্যু তা বহাল রেখেছেন গভীর নিষ্ঠা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে। শিক্ষাজীবনে তিনি বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহী কেন্দ্রে ঘোষিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কার্যকারিতা’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনৈতিক দর্শন ও গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে তার চিন্তাভাবনা প্রবন্ধ ও গবেষণায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ড. লিপির সাহিত্যকর্মে স্থান পেয়েছে গভীর রাজনৈতিক সচেতনতা, মানবিক বোধ, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ। তার কবিতায় যেমন রয়েছে সময়ের আঁধার ভেদ করে মুক্তির আহ্বান, তেমনি গল্প ও প্রবন্ধে তিনি সমাজবাস্তবতার অসংগতি, নিপীড়ন ও সংগ্রামের ধারাবিবরণী তুলে ধরেছেন অনন্য দক্ষতায়। 📚 প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ 🖋️ কবিতাগ্রন্থ এ সময় অন্ধকারের রক্তিম গোধূলী বেলায় মুক্তির মিছিলে 📘 প্রবন্ধ ও গবেষণা রক্তসিঁড়ি (রাজনৈতিক প্রবন্ধ) শেকড়ে ফোকর (বিবিধ প্রবন্ধ) বাংলাদেশে ভাসানী ন্যাপের রাজনীতি (গবেষণা) 📖 গল্পগ্রন্থ পুতুলবাড়ির ইতিকথা (শিশু-কিশোর গল্প) 🌿 ব্যক্তিত্ব ও উত্তরাধিকার শামিমা আকতার লিপি ছিলেন বিনয়ী, সংগ্রামী ও মানবসেবায় উৎসর্গিত একজন সৎ মানুষ। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে তিনি ছিলেন মিষ্টভাষী, সংবেদনশীল ও সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। সমাজের জন্য কিছু করা—এটাই ছিল তার নিরবিচার অভিপ্রায়। সাহিত্যকে তিনি কেবল শিল্পরূপে নয়, ন্যায়, নীতি ও দায়বদ্ধতার প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও দেখতেন। ২০২১ সালে তার অকাল প্রয়াণ বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু তার রচনাবলি, মনন এবং আদর্শ আজও বেঁচে আছে—সাহিত্যের পাতায় এবং পাঠকের হৃদয়ে। ড. শামিমা আকতার লিপি ছিলেন একাধারে চিন্তাশীল লেখক ও অন্তঃপ্রাণ মানবপ্রেমী। তাঁর সৃষ্টিকর্ম শুধু পাঠ নয়, পাঠের ভেতর দিয়ে এক ধরনের সময়সচেতন জাগরণ।