ফ্রান্সের ইতিহাসে ‘জোয়ান অব আর্ক’ এক বিস্ময়কর নাম। এক কিশোরী, যে নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছিল একটি জাতির আশা ও প্রতিরোধের প্রতীক। আসাদ চৌধুরীর লেখা “জোয়ান অব আর্ক” গ্রন্থটি আমাদের সামনে তুলে ধরে সেই রূপকথার মতো বাস্তব জীবনের গল্প, যেখানে সাহস, দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগ একাকার হয়ে গেছে।
এই বইয়ে আমরা দেখি, জোয়ান অব আর্ক বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। দখলদার বাহিনির কবলে পড়া দেশে একটি মেয়ের ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে যাওয়া ছিল অকল্পনীয়। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে হলে তাকে পুরুষের পোশাক পরতেই হয়। ভোকুলের সাধারণ মানুষ নিজেরাই এগিয়ে এসে তাকে অন্তর্বাস, ভারি বুট জুতা, কুঠার ও সুন্দর একটি ঘোড়া উপহার দেয়। গভর্নর রোবেয়ার দু বোড্রিকুর দেন একটি তলোয়ার। নিজের দীর্ঘ কেশ নিজ হাতে কেটে ফেলে জোয়ান সম্পূর্ণ করে নেন যুদ্ধের সাজ- যেন এক মুহূর্তেই রূপান্তর ঘটে যায় এক গ্রাম্য কিশোরী থেকে সংগ্রামী সৈনিকে।
আসাদ চৌধুরী অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাষায় দেখিয়েছেন, জোয়ান ঘোড়ায় চড়তে জানতেন না, যুদ্ধের নিয়ম-কানুনও তার অজানা ছিল। তবুও তার উপস্থিতিই সৈন্যদের সাহস জুগিয়েছিল। দুর্জয় সাহস, গভীর দেশপ্রেম ও নির্ভীক চিত্তের অধিকারী জোয়ান অব আর্ক যুদ্ধক্ষেত্রেও হয়ে উঠেছিলেন করুণার প্রতিমূর্তি। শত্রুর প্রতিও মানবিক আচরণ ছিল তার চরিত্রের এক অনন্য দিক।
এই গ্রন্থে জোয়ানের মৃত্যুর পরবর্তী প্রভাবও গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তার আত্মবলিদান ফরাসি জাতির মনে নতুন চেতনা ও উদ্দীপনার সঞ্চার করে। সেই চেতনাই ফ্রান্স থেকে ইংরেজদের অবরোধের চিহ্ন মুছে ফেলতে সহায়তা করে।
জোয়ান অব আর্কের জীবন আমাদের শেখায়- বয়স, লিঙ্গ কিংবা অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা দেশপ্রেম ও সত্যের পথে বাধা হতে পারে না। আসাদ চৌধুরীর এই জীবনীগ্রন্থ শুধু ইতিহাস নয়, এটি সাহস ও মানবিকতার এক অনুপ্রেরণামূলক দলিল, যা পাঠককে ভাবতে শেখায় নিজের অবস্থান ও দায়িত্ব সম্পর্কে।
আসাদ চৌধুরী। জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, উলানিয়া, বরিশাল। বাংলাদেশের কবিতায় ‘তবক দেওয়া পান’ নিয়ে আসাদ চৌধুরীর আর্বিভাব। স্বল্পবাক, ঋজু এবং বক্তব্য প্রকাশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিকীর্ণ এই কবি, বাংলাদেশের ষাট দশকের কবিতায় সংযোজন করেছেন নতুন মাত্রা। এ মাত্রা লক্ষণীয় তাঁর ভাষা ও প্রকরণে; যেখানে তিনি ঐতিহ্য, শে¬ষ, প্রেম, সৌন্দর্য ও মরমি চেতনার সংমিশ্রণ ঘটান। আসাদ চৌধুরী, তাঁর কবিতায় মরমি-মানসিকতা নিয়ে বাঙালি জাতির ঐতিহ্যকে অনুসন্ধান করেছেন। আর তাই ছন্দে মেজাজে এবং বক্তব্যে তিনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় এক যুগ সময়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এবং জয়বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। জার্মানির কোলনের ভয়েস অব জার্মানির বাংলা বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন (১৯৮৫-৮৮)। বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রায় ছাব্বিশ বছর।
আসাদ চৌধুরী কবিতা আবৃত্তি করেন। বেতার টিভিতে উপস্থাপনা করেন। প্রচুর নাটক সিনেমা দেখেন। ভ্রমণ তার নেশা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোতেই তার আনন্দ।
সব বয়সী পাঠকের জন্য কবিতা, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি বিশেষভাবে ছোটদের জন্য লিখেছেন ছড়া-কবিতা, রূপকথার গল্প, অনুবাদ এবং জীবনীগ্রন্থও। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭), অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক (২০১৩) সহ অসংখ্য পুরস্কার। সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণচঞ্চল চির তারুণ্যের প্রতীক আসাদ চৌধুরী ছোট বড় সকলেরই প্রিয় মানুুষ।