ডাকাতেরা আমার বড়’চা মানে চেয়ারম্যান চাচার কাছে উড়ো চিঠি দিয়েছে। উড়ো চিঠিতে কী আছে তা আমরা জানি না। সেই চিঠি আমাদের দেখানো হয়নি। কিন্তু আমরা কানাঘুষায় জানতে পেরেছি সেই চিঠি নাকি মানুষের রক্ত দিয়ে লেখা। ঠিক লেখা নাকি নেই সেখানে, শুনেছি সেখানে কি সব ছবি আঁকানো। আর চিঠির সাথে নাকি প্যাকেট করে একটা জিনিসও পাঠিয়েছে। এক টুকরো দুধ সাদা কাফনের কাপড়। কাফনের কাপড় হচ্ছে সংকেত। অর্থাৎ ডাকাতি কাজে বাধা দিলে, কোনোভাবে পুলিশকে জানালে বা নিয়ে এলে কাফনের কাপড় ব্যবহার করার মতো পরিণতি হবে। অবশ্য পুলিশকে জানানোর প্রশ্নই ওঠে না। সুন্দরবনের প্রায় কাছাকাছি আমাদের এই অজপাড়াগাঁ থেকে উপজেলায় পুলিশের থানা পাক্কা সাতাশ মাইলের পথ। আর সেই মাইল যে সে মাইল নয় যাকে বলে ডাল ভাঙা ক্রোশ। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় মাইল দশেক কাঁচা মাটির রাস্তা। আর এই বর্ষায় সেই রাস্তা গরু মহিষ চরে এরকম এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে যে তা কল্পনার অতীত। তা ভেদ করে যেতে গোটা একটা দিন লেগে যাবে।
সুন্দরবনের নিকটবর্তী দক্ষিণাঞ্চলের এই অজপাড়াগাঁয়ে এখনও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। আসি আসি করেও কেন আসছে না তার কোনো সঠিক কারণ জানি না। আমার বড় চাচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েও আনতে পারছেন না। এবারে যদি না আনতে পারেন তাহলে আর চেয়ারম্যানি নির্বাচনে জিততে হবে না।
এই ঝারিয়াটা গ্রামের একমাত্র বিশাল বাড়িটা আমাদের গোষ্ঠীর। বিশাল সীমানা এক মানুষ উঁচু ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার উপর কাচের টুকরো কোনাকুনি করে বসানো। কিন্তু সেই কাচের টুকরো এখন ভেঙে সমান হয়ে গেছে। এই গ্রামে প্রথম পাকা বাড়ি হিসেবে আমাদের বাড়িটাই উঠেছিল। এখন অবশ্য আশপাশে আরো কয়েকটি পাকা বাড়ি হয়েছে। কিন্তু পাঁচিল ঘেরা আমাদের পাকা বাড়িটা এখনও মানুষ অন্য চোখে দেখে।
আমার বড় চাচা এই গ্রামে পর পর সাত মেয়াদে চেয়ারম্যান হয়েছেন। সাত মেয়াদে পঁয়ত্রিশ বছর দীর্ঘ সময়। সেই যৌবনকালে চেয়ারম্যানির দায়িত্ব নিয়ে এখন ষাট বছরের বৃদ্ধ। তারপরও গ্রামের লোকে ষাটোর্ধ বৃদ্ধ বড়চাচাকে ছাড়া আর কাউকে বোঝে না। আর এই দীর্ঘমেয়াদির চেয়ারম্যানির ইতিহাসে বড় চাচার সম্পতি কম বাড়েনি। দুর্মুখেরা বলে, বছর বছর গম চুরির টাকায় নাকি বড় চাচা টাকার পাহাড় গড়েছেন। আমরা অবশ্য সেই টাকার পাহাড় কখনও দেখিনি। তবে বড় চাচা চেয়ারম্যান হওয়ার কল্যাণে আমার বাবাসহ বাকি পাঁচ চাচার অবস্থা ফিরেছে। গ্রামের যাবতীয় দখলদারি, সুদ-ঘুষের কারবার, ব্যবসাপাতি, দোকানপাট সবকিছুই আমার বাপ-চাচারা দখল করে নিয়েছে। বাজারের একমাত্র পাকা মার্কেটও আমাদের পারিবারিক। আর এসব কারণে ডাকাত যদি এই গ্রামের কোনো বাড়িতে উড়ো চিঠি দেয় তো সেটা তো আমাদের বাড়িতেই দেবে। এই গ্রামের এত ধনসম্পত্তি আর কাদের আছে। অবশ্য এর আগেও আমাদের বাপ-চাচারা এরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে। তবে সেটা ঠিক এভাবে শো-ডাউন করে ডাকাতি নয়। শো-ডাউনের কথায় পরে আসছি। ডাকাতরা বড় চাচা অথবা অন্য কোনো চাচার কাছে বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে এসেছে। এবং চাচারা সেই নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত সময়ে টাকা দিয়ে এসেছে। এভাবেই চলে আসছিল এতদিন। কখনও পুলিশকেও পর্যন্ত জানানো হয়নি। সুন্দরবনের কাছাকাছি থাকায় ডাকাতরা পুলিশ নিয়ে আসার আগেই পালিয়ে সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নেবে। তারপর পুলিশ চলে গেলে ফিরে এসে সকলকে ধরে প্যাদানি দেবে। কী দরকার প্যাদানি খাওয়ার। অত ঝামেলার। তার চেয়ে যা চায় দিয়ে এলেই ল্যাঠা চুকে গেল।
কিন্তু এবারে ব্যতিক্রম। এবারে ডাকাতের দল অদ্ভুত দুর্বোধ্য ভাষায় চিঠি দিয়েছে। সেটাকে ঠিক চিঠি বলা যাবে কিনা সন্দেহ। গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির শুণ্ডির রাজার পাঠানো চিঠির মতোই। তার মধ্যে বন্দুকের ছবি আঁকানো। শিংওয়ালা মাথা, নাচের পুতুলসহ আরো অনেক কিছু। আমাদের ছোটদের সেই চিঠি দেখতে দেয়া হয়নি। তবে কানাঘুষায় শুনেছি চিঠিতে নাকি মৃতদেহের বীভৎস ছবি আঁকানো আছে। আর কাফনের কাপড় পাঠানোর কথা তো আগেই বলেছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এবারের পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যঘেরা। প্রথম কথা হচ্ছে অন্যবারের মতো এবারে টাকার কোনো পরিমাণ উল্লেখ করেনি। অন্যবার পঞ্চাশ হাজার, লাখ টাকার কথা চিঠিতে উল্লেখ থাকে। কোথায় কোন শ্মশানঘাটে কবরস্থানে গিয়ে সেই টাকা দিয়ে আসতে হবে সেটা বলা থাকে। এবার তেমন কিছু নেই। ডাকাতেরা নিজেরাই বাড়িতে এসে ডাকাতি করে যাবে। চিঠিতে একটা ঘড়ির ছবিও আছে। তাতে বারোটার কাঁটা আঁকানো। কাজেই ধারণা করা হচ্ছে, মধ্যরাতেই ডাকাতেরা আসবে। হয় তারা বন্দুক নিয়ে ডাকাতি করতে আসবে, নয়তো আমার বড় চাচার লাইসেন্স করা বন্দুকটাও ডাকাতি করার সময় নিয়ে যাবে। এরকমও হতে পারে বন্দুকটা আমাদের ব্যবহার করতে নিষেধ করার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ব্যবহার করলে ফল ভালো হবে না।
প্রিন্স আশরাফ জন্ম গ্রহণ করেন সাতক্ষীরার বড়দলে, ৪ ফেব্রুয়ারি । বাবা ডা. সফেদ আলী সানা। মা সাহারা বানু। পেশায় চিকিৎসক হয়েও লেখালেখিতে ঝােঁকটা বেশি। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং মাসিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন । রহস্য, থ্রিলার, হরর, অতিপ্রাকৃত, সায়েন্স ফিকশন লিখলেও মূল ধারার গল্প-উপন্যাসেই আগ্রহটা চোখে পড়ে। শিশু সাহিত্যেও সমান পদচারণা। লেখালেখির পাশাপাশি আলাে ও ছায়া নামে সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করছেন । দৈনিক যায়যায়দিনের সম্পাদনা সহকারীর দায়িত্বে আছেন । বৈশাখী চ্যানেলে নাটক লিখে পুরস্কৃত হয়েছেন । ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী সুলেখিকা তাহমিনা সানি ও একমাত্র কন্যাসন্তান সারাহকে নিয়ে সুখী গৃহকোণ ।