অতীত আমরা যতই ভুলে যাবার চেষ্টা করি না কেন তাতে হয়তো সে ধূসর কিম্বা পাঁশুটে হয় কিন্তু কখনোই মিথ্যে হয়ে যায় না বা হারিয়ে যায় না। আবার অতীত ঘেঁটে নিজের বংশের অহংকার করলে অতীত কখনই বর্তমান হয় না, অতীত অতীতই থেকে যায়।
সরাসরি বললে, মানুষের জীবনে বংশ বলে কিছু নেই, আছে কর্ম। কর্মর মাধ্যমেই মানুষ তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি পরিচয় তৈরি করে বা করার চেষ্টা করে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কেউ কেউ হয়তো তাদের পূর্ববর্তীদের তৈরি করা সেই পরিচয় নিয়েই অহংকার করে; নিজে কিছুই করে না।
‘পাঁশুটে’ — নামটাই যেন অতীতের ধূসরতার আভাস দেয়। ‘ধূসর’ অর্থে 'পাঁশুটে' শুধু একক কোনো ব্যক্তির নয়, বরং পুরো একটি বংশ, তাদের অতীত, তাদের ইতিহাসকে ধারণ করে। গল্পটি একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, আর তা হলো, যতই আমরা অতীতকে ভুলে থাকার চেষ্টা করি না কেন, তা মিথ্যা হয়ে যায় না—শুধু হয়তো রঙ হারিয়ে ফেলে।
উপন্যাসটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর বিস্তৃত চরিত্রজাল ও বংশপরম্পরার গল্প। আপনার বাবার বাবা,তার বাবা,তার বাবা,তার বাবা.....।ব্যাপারটা মজাদার না!তারচেয়ে মজার বিষয় হলো এখানে দুই মেরুর দুটি পরিবারের অতীত নিয়ে লেখা হয়েছে।এই উপন্যাসটা সাধারণ জমিদার বনাম দিনমজুরের কাহিনী নয়, বরং উপন্যাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ইতিহাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বিবর্তনের আখ্যান।
জমিদারি নিয়ে গ্রামে অনেক বচন প্রচলিত।আমার মায়ের পূর্বপুরুষরা মিয়াজী ছিলো,এরপর আমার বড়ো নানা হজ করার পর বাড়ির নাম হাজী বাড়ি...এভাবেই পরিবর্তন হচ্ছে।
তারপর আপনাকে যদি বলি যে আপনার বংশের পদবী অনুযায়ী কি আপনার কর্মস্থল?
উত্তর-' না'।
আর এমনটাই হওয়াই স্বাভাবিক। পাঁশুটে বইয়ে গাজী বংশের পূর্বপুরুষদের বিস্তারিত ইতিহাস গল্প আকারে তুলে ধরছে।পুরো বইয়ে ইতিহাসের অংশগুলো চৌম্বিক লাগছে।গল্পের গাজী বাড়ির বিকাশ এবং পরবর্তীতে শাহ্ সাবের বাড়ি হয়ে ওঠার ইতিহাস যেমন মনোযোগ কেড়ে নেয়, তেমনি কমিশনার কাদির শেখের পেছনের সংগ্রাম ও বিবর্তনের গল্পও পাঠককে ভাবায়।গাজী বাড়ির জমিদারি একসময় শেষ হয়ে যায়,যার পিছনে রয়েছে কাছের মানুষের ইন্দন।
মনা শেখের তেইজ্য পুত্র অকইলা তার নাম থেকে মূর্খতা মুছে ফেলার স্বপ্নে বিভোর থাকে।স্রষ্টা সে স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগও দেয়।তার ছোটো ছেলে কাদির শেখকে ভিটে বাড়ি বাদে সব বিক্রি করে পড়াশোনার কাজে লাগিয়েছে। আদৌ কী এই মূর্খতা মুছতে পেরেছে?
উপন্যাসটি কেবল অতীতের বর্ণনা নয়, বরং তা প্রশ্ন তোলে আমাদের পরিচয়, বংশ, পদবী ও সামাজিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা নিয়ে। লেখক অতীতের গৌরবময় কিংবা করুণ ইতিহাস টেনে এনে আমাদের আহ্বান জানান—বংশের অহংকার ভুলে যেতে, আর মানুষ হিসেবে নিজেদের মূল্যায়ন করতে।
ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ নিয়ে লেখা ‘পাঁশুটে’ পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে চরিত্রের আধিক্যে খেই হারিয়ে ফেলা স্বাভাবিক—তবে সেটাই হয়তো লেখকের কৌশল, যাতে পাঠক নিজেই খুঁজে নিতে পারে নিজের অবস্থান এই ধূসর বর্ণিলতায়।
‘পাঁশুটে’ একটি চিন্তামগ্ন, প্রজন্মান্তরে বিস্তৃত, আত্মপরিচয় সন্ধানী উপন্যাস। যারা অতীত, ইতিহাস, এবং পারিবারিক শিকড় নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন—তাদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য বই।