রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানে একটি সাহিত্য যুগ, একটি কাল। তিনি কবিদের কবি। যা কাল থেকে কালে প্রবাহমান। কয়েক লাইন বা কয়েকটি প্যারায় তাঁর সম্পর্কে লেখার চেষ্টা বোকামিমাত্র। বাংলা সাহিত্যে শিশু-কিশোর উপযোগী যে সাহিত্য রয়েছে এসব কবিগুরুর যুগেও হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। শিশু-কিশোর সাহিত্য সৃষ্টি সহজ কথা নয়। এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো লেখাটি কতটা শিশু-কিশোর উপযুক্ত হয়েছে তা বিবেচনা করা। শিশু-কিশোর মনকে আকৃষ্ট করতে সফল সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি তাই চ্যালেঞ্জের। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে হলে নিজেকেও শিশু-কিশোর মনের হতে হয়। শিশু-কিশোরদের মন, চাওয়া-পাওয়া,আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার উৎস বুঝতে হয়। এগুলো বুঝতে পারলেই সার্থক শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা সম্ভব। কবিগুরুও শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে গিয়ে নিজের প্রাণকে সেই সময়ে নিয়ে গেছেন। এমনিতেই সারল্য ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য হলো, শিশু-কিশোরকালে আমরা যা পাঠ করি তার অনেকটা আবার আমাদের যৌবন-বার্ধক্যেও মনের কোণে ঠাঁই নেয়। এটাই সৃষ্টির সার্থকতা। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির বিশালতা আমাদের সাহিত্য ভান্ডারকে পূর্ণতা দিয়েছে। আজও আমরা সেই কবিতা, ছড়া আবৃত্তি করি। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য কবিতা, গল্প বা জীবনীও লিখেছেন। ছাত্রাবস্থায় কিশোর চরিত্র ফটিকের সাথে পরিচয় হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ছুটি” গল্পে। ফটিকের কৈশোরের উচ্ছ¡লতা, গ্রামের গÐি পেরিয়ে শহরের জীবনে গিয়ে ফটিকের বন্দিত্ব, মায়ের কাছে যাওয়ার আকুল আবেদন, প্রকৃতির সাথে মিশে শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা ফটিকের শেষ পরিণতি আমাদের চোখে জল এনে দেয়। তাঁর “কাবুলিওয়ালা” নাটকটি যা চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে সেখানে অন্যতম প্রধান চরিত্র “মিনি”। ভিনদেশি কাবুলিওয়ালার মিনির প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে কাহিনি এগিয়েছে। মিনি নামের ছোট্ট মেয়েটির চরিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার “ডাকঘর” নাটকের অমলের চরিত্রও আমাদের মন কেড়ে নেয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।