ঘরে বাইরে ও তার মূল বৈশিষ্ট্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি দৌলত কাজি তাঁর কাব্যে লিখেছেন— ‘ফাটউক সে নারীর হৃদয় দারুণ। এক ছাড়ি ভাবয় যে দোসরক গুণ ॥১ স্বামী বর্তমানে অন্যের চিন্তা দূষণীয়—এই সংস্কার যে নারীর অন্তরের সঙ্গে কিভাবে জড়িত, তা উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি থেকে বেশ বোঝা যায় । পরদার প্রেম এবং বিবাহিতা নারীর পরপুরুষের প্রতি আসক্তি বা অনুরাগ দুইই মন্দ, তাতে সন্দেহ নেই, তথাপি মানব-জীবনে তা ঘটে থাকে বলে সাহিত্যিকরা সেটাকেও উপেক্ষা করতে পারেন নি। প্রাচীন সংস্কারে আচ্ছন্ন আদর্শানুরাগী ভারতবাসীর পক্ষে এ ধরনের নিষিদ্ধ প্রেম সাহিত্যে প্রবেশ করানো যেমন কঠিন তেমনি দুঃসাহসের কাজ। তথাপি বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম তাঁর সাহিত্যে অতি সাবধানে এইরূপ নিষিদ্ধ প্রেমকে স্থান দিলেন। ‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫) উপন্যাসে প্রতাপ-শৈবলিনীর মধ্যে শৈশব কাল থেকে যে ভালোবাসা ছিল, শৈবলিনীর বিবাহের পরেও শৈবলিনীর অন্তর থেকে তা মুছে ত যায়ই নি, প্রতাপের অন্তরের অন্তস্থলেও তা গভীর ও অক্ষুণ্ণ ছিল। এই অবৈধ প্রেম বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে কোনও রকম প্রশ্রয় পায় নি এ কথা সত্যি, কিন্তু প্রতাপ যে বঙ্কিমচন্দ্রের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয় নি, তার প্রমাণ মৃত্যুপথযাত্রী প্রতাপের কথাগুলি থেকেই পাওয়া যায়। “কি বুঝিবে, তুমি সন্ন্যাসী? এ জগতে মনুষ্য কে আছে যে, আমার এ ভালোবাসা বুঝিবে। কে বুঝিবে, আজি এ ষোড়শ বৎসর, আমি শৈবলিনীকে কত ভালোবাসিয়াছি । পাপচিত্তে আমি তাহার প্রতি অনুরক্ত নহি-আমার ভালোবাসার নাম—জীবন বিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা। শিরে শিরে, শোণিতে শোণিতে, অস্থিতে অস্থিতে, আমার এ অনুরাগ অহোরাত্র বিচরণ করিতেছে।” রজনী (বঙ্গদর্শন ১২৮১-৮২) উপন্যাসেও এই অসামাজিক প্রেমের আভাস পাওয়া যায় লবঙ্গলতা ও অমরনাথের মধ্যে। লবঙ্গ ও অমরনাথের প্রতি বঙ্কিমের হৃদয়ে যে করুণা ছিল তার প্রকাশ ঘটেছে উপন্যাসের শেষে, দুজনের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।