রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর কাব্যিক ভাবানুভব মূর্ত হয়ে ওঠে। সবকিছুর মধ্যে পদলালিত্যের নন্দনস্রোত অবিরামভাবে বইতে থাকে। এ তাঁর সহজাত প্রায়স প্রবৃত্তি বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। এ সুবাদে রবীন্দ্রসৃষ্টি একটা ভিন্নতর মাত্রাযোগে আবির্ভূত হয়ে থাকে। একটা সবিশেষ অনুভবপ্রাণতা এর মধ্য দিয়ে বয়ে চলে। তাঁর এই প্রবণতা আজন্ম বেড়ে ওঠার সময় থেকেই লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ ভাবপ্রবণতার মধ্যে একটা পরিবর্তনশীলতা লক্ষণীয়। তিনি বাল্যকাল থেকেই মনের মধ্যে অপরিসীম কৌতূহলবোধ লালন করেছেন। জগৎ ও জীবনের প্রতি একটা সম্মোহভাবনা সবসময় তাঁকে তাড়া করে ফেরে। ভৃত্যরাজক পরিবারে বেড়ে ওঠলেও সবসময় সুদূরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করত। প্রকৃতির মায়াবি হাতছানি তাঁকে নিশির মতো পেয়ে বসে। কখনো এক মুহূর্তের জন্য তিনি এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পান নি। এমনই একটা অন্তর্গত তাগিদ—তাড়না থেকে রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ছুটে বেড়িয়েছেন। অনবরত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য সুস্থিত হতে পারেন নি। দেশ-বিদেশ, পাহাড়-পর্বত ঘুরে ঘুরে অস্থির হয়েছেন। এমনকি তিনি ঘরের মধ্যেও একের পর এক কামরা বদল করতেন। তাঁর আজীবন তীর্থক্ষেত্র শান্তি নিকেতনেও অনেকগুলো ঘর নির্মিত হয়েছিল। তাঁর এই মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ যাবতীয় রচনাসৃষ্টিতেও লক্ষণীয়। অনুরূপ একটা মনন-প্রয়াস থেকেই তিনি বহুবার ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এবং সেখানকার সমাজ জীবন পর্যবেক্ষণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। প্রথমবার তিনি মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে বিলাতে পাড়ি জমান। এই যাত্রাপথে তাঁর সীমাহীন উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ লক্ষ করা যায়। যা য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রগুচ্ছে নানাভাবে নানাভঙ্গিতে ফুটে ওঠেছে। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র গ্রন্থে বালক রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর অনুভবপ্রবণতা আবিষ্কার করা সম্ভব। মাত্র ১৮ বছর বয়সে এতদূর অনুসন্ধিৎসা ভাবতেও অবাক লাগে। এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বিশ্লেষণশক্তি যে- কোনো পাঠক সমাজকে বিস্ময়াবিষ্ট করে ছাড়ে। সমকালীন ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে তিনি অনর্গল ভাষায় বলে গেছেন। এতে করেই সে-বয়সে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-দীক্ষা, ধ্যান-জ্ঞান, অন্বেষা-অনুসন্ধিৎসা ও চিত্তগত সমৃদ্ধির সন্ধান মেলে। এক অফুরন্ত সম্ভাবনাময় যুবকের প্রতিমূর্তি আমাদের সামনে অভিব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে। এরকম একজন ব্যক্তিত্ববান পুরুষ বিশ্বপৃথিবী জয় করতে সমর্থ হবেন—এতে আর সন্দেহ কি। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রগুচ্ছের পরতে পরতে অলোকসামান্য রবীন্দ্রপ্রতিভার স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যায়। সকালের সূর্য যেমন অনেক সময় দিনের প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়ায়—এসব পত্রেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।