এ উপন্যাসের কাহিনি মূলত একজন নারীর শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যকালে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা নিয়ে লেখা। খুব বেশি কল্পনাশ্রিত নয়, নেই মেদবহুল বর্ণনাও। সাধারণ ঘটনাকে ঘনঘটা করে, অবিশ^াস্য করে সাজিয়ে পাঠককে ধোকা দেওয়া হয়নি। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত এক নারীর নিঃসঙ্গতা ও অসহায়ত্বের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে গদ্যের ভাষায়। ইতোমধ্যে কবি—সাহিত্যিকেরা এ বিষয়ে অনেক গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান লিখেছেন। নচিকেতার গানের পর বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আর কোনও গান, কবিতা, গল্প—উপন্যাস মানুষকে তেমন আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এ উপন্যাসের কাহিনি একটু ভিন্নরকম। কেউ কখনও যা বলেনি বাসার তাসাউফ তা—ই বলেন। এ উপন্যাসেও ব্যতিক্রম হয়নি। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত এক নারীর প্রতিদিনের জীবনযাপনের গল্প যে—ভাবে উপস্থাপন করেছেন তা পড়ে যে কেউ চমকে উঠবে, কেউ কেউ দীর্ঘশ^াস ফেলবে আর কারও কারও চোখের পাতা ভিজে উঠবে জলে। বিশ^াস না হয় বইটি পাঠ শেষে আমার কথার সত্যতা যাচাই করে নিন। আপনার চোখের জল বাঁধভাঙা ে¯্রাত হয়ে ছুটবে যখন পড়বেন ‘...জীবনভর এত এত যন্ত্রণা সহ্য করে বড় করেছি যে ছেলেমেয়েকে জীবনের শেষবেলায় এসে তারাই বৃদ্ধাশ্রমের রাস্তা চেনায়Ñ এ দুঃখ কার কাছে কইব আর কী করে সইব...?’ আমরা জানি, একজন নারীর শৈশব—কৈশোর কাটে মায়ের আশ্রয়ে, যৌবন কাটে স্বামীর আশ্রয়ে আর বার্ধক্যে এসে আশ্রয় খেঁাজে সন্তানের কাছে। কিন্তু সন্তান যখন আশ্রয় না দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয় তখন তার মতো অভাগী আর কেউ থাকে না। এ উপন্যাসে প্রধান চরিত্র রায়জন নেছা জীবনের শেষপ্রান্তে এসে মা—বাবা, স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র ছেলের কাছেও আশ্রয় না পেয়ে চরম অসহায় কণ্ঠে বলে, ‘এখন আমি কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো?’
বাসার তাসাউফের লেখালিখি শুরু শৈশবে-কৈশোরেই। তখন স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে তথাকথিত ‘আউট’ বই নিয়ে দিন-রাত নিমগ্ন থাকত আর ছড়া-কবিতা লেখার চেষ্টা করত বলে বাড়ির লোকেরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। অনেকে ভর্ৎসনা করে বলত, ‘ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে এসব নিয়ে মজে থাকলে শেষে না আবার পস্তাতে হয়।’
শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে এসেছে বহুদিন হলো। মধ্যযৌবনে এসে যখন ছড়া-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, থ্রিলার, রম্য, নন ফিকশন, শিশুতোষ ও কিশোর উপযোগী- সব মিলিয়ে ১৮টির মতো বই প্রকাশ হয়ে গেছে- এখনও বাড়ির লোকেরা সেই অমোঘ কথাগুলো বলে বেড়ায়। কিন্তু কথাগুলো এখন আর তাকে বিচলিত করে না। সে বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে সব মানুষ সফল হয় না। কেউ কেবল বেঁচে থাকে, কেউ আবার কোনোমতে টিকে থাকে। বাসার তাসাউফ কেবল বেঁচে থাকতে চায়নি, চেয়েছে কোনমতে টিকে থাকতে। টিকে থেকে দেখতে চেয়েছে এই পৃথিবীর এমন কিছু বিষয়- যা অন্য কেউ দেখেনি। রাতের নির্জনে যে টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ে, ফসলের মাঠ থেকে ভেসে এসে শিয়ালের ডাক আর ঝিঁঝি পোকার কোরাস যে মনের গহীনের বিষাদের আবহ তৈরি করে- তা কি কেউ শুনতে পেয়েছে কখনও? কেউ কি অবগাহন করেছে নারিকেল গাছের চিরল পাতার ফাঁকে জেগে থাকা পূর্ণিমার চাঁদের অবারিত আলোর বন্যায়? উপভোগ করেছে কি মেঘ জমে থমথমে আকাশ থেকে উপচেপড়া ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দ? হয়তো আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মাথার ওপরে ছাদ থাকলে বৃষ্টির শব্দ হয় উপভোগ্য আর পায়ের তলায় মাটি থাকলে হাওয়াই চপ্পলের শব্দও নূপুরের নিক্কণ ধ্বনি মনে হয়। বাসার তাসাউফ আকাশকে ছাদ আর মাটিকে অকৃত্রিম নির্ভরতা মেনে এই পৃথিবীতে দিন যাপন করে চলেছে। সফল ও ব্যর্থ মানুষে ভাগ হয়ে যাওয়া সমাজ-বাস্তবতায় স্বেচ্ছায় আপন করে নিয়েছে নিসঙ্গতাকে। অথচ তার চারপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড় আর সে যেন এক ঝাঁক কাকের কোলাহলে একটি নিভৃত কোকিল। আপন মনে গান গেয়ে যায়। কেউ শুনলেও তার গান চলে, কেউ না শুনলেও তার গান থামে না।