দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাংলাদেশে প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ থেকে গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা ছয় কোটির মত এবং চরমভাবে ব্যর্থ প্রায় তিন কোটি মানুষ। মানব-মর্যাদার বিবেচনায় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই পিছিয়েপড়া। শিক্ষাহীনতা, প্রশিক্ষণহীনতা, স্বাস্থ্যহীনতা এবং কর্মহীনতা বা কর্মস্বল্পতা এসকল মানুষের জীবনে অভিশাপ। স্বাধীনতার ছত্রিশ বছর পরেও এদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবর্তন প্রক্রিয়ায় জনঅংশীদারিত্ব। আর এ কারণেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হলেও এক বিশাল জনগোষ্ঠী বঞ্চনার শিকার থেকে গেছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে এমন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াসমূহ যা সকল মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সকলের মধ্যে নিহিত সক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ ঘটায় যাতে দেশ ও ব্যক্তি উভয়েই এগিয়ে চলে উন্নতির পথে, সমৃদ্ধির পথে।
মঙ্গা এই বিশাল দারিদ্রদ্র্য ও বৈষম্য সমস্যার একটি বিশেষ দিক। মঙ্গাকে মৌসুমী বা নিরব দুর্ভিক্ষাবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নিরব বলছি। এজন্যে যে, মঙ্গা আক্রান্ত মানুষ বছরের পর বছর কৃষি বহির্ভূত সময়ে প্রকট অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন। জমিজমা বিশেষ না থাকার কারণে খাদ্য উৎপাদনে তাদের সুযোগ সামান্যই বা একেবারেই নেই। ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ অকৃষিখাতে কিছু কর্মসংস্থান হলেও সাধারণত শ্রম বিক্রিই এসকল মানুষের জীবনযাপনের বা প্রধান উপায়। কৃষি বহির্ভূত মৌসুমে তারা চরম বেকারত্বে পড়েন, ফলে তাদের খাদ্যসমস্যা চরম আকার ধারণ করে। বছরের পর বছর এভাবে মঙ্গা আক্রান্ত হওয়ার ফলে তারা ক্রমান্বয়ে দারিদ্র্য থেকে দারিদ্র্যতর এবং অবশেষে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অপরদিকে পুষ্টির অভাবে তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং তারা শ্রম দেবার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। তাই মঙ্গা অনেকটা নিরবে কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবে তাদেরকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়। অনেক সময় পুরুষরা কাজের সন্ধানে দেশের অন্যত্র যান, কখনো কাজ পান কখনো পান না; আর কাজ পেলেও আয় হয় স্বল্প, বাড়িতে তেমন কিছু পাঠাতে পারেন না। এ অবস্থায় বাড়িতে থাকা নারী ও শিশুরা হয় চরমভাবে ভুক্তভোগী।
বিধ্বংসী বন্যা বা প্রকট খরা দেখা দিলে এসকল মানুষের দুরবস্থা সার্বিকভাবে সংঘাতিক রূপ ধারণ করে। এই সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যাপক প্রয়োজন পড়ে।
মঙ্গা দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ঘটে থাকে বলে সাধারণত বলা হয়।
কিন্তু দেশের অন্যান্য অনেক স্থানে মঙ্গা অবস্থা দেখা দিয়ে থাকে, বিশেষ করে নদীভাঙ্গন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হলে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে আসলে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জনঅংশগ্রহণভিত্তিক মৌলিক উন্নতি না ঘটলে দারিদ্র্যপীড়িত এবং মঙ্গা-আক্রান্ত মানুষের দুর্দশার অবসান যাইবে না। এই প্রক্রিয়ায় কৃষি, গ্রামীণ অকৃষিখাত, ক্ষুদ্র শিল্প, শহুরে অনানুষ্ঠানিক খাতসমূহে গুরুত্ব আরোপ করা জরুরি। কেননা এ সকল খাতেই পিছিয়েপড়া মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবার উপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জাহাঙ্গীর আলম মঙ্গা ও কৃষি এই বইটিতে দারিদ্র্য ও মঙ্গা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে ১৬টি প্রবন্ধ সংকলন করেছেন। এই প্রবন্ধগুলো থেকে একটি কথা পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে এসেছে যে, জাতীয় উন্নয়ননীতি এবং বাজেট বিন্যাসে কৃষির উপর যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষির উন্নতির জন্য কৃষি শিক্ষা ও গণমাধ্যমের সহায়তায় সচেতনতা ও উন্নয়ন যোগাযোগ বৃদ্ধি করার উপর সঙ্গতভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। কৃষির পাশাপাশি কৃষকের উন্নয়ন জরুরি একথাটি তার লেখায় ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের কৃষককুল কৃষি উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি করেছেন কিন্তু তাদের অবস্থার উন্নতি হয়নি।
দীর্ঘমেয়াদে কৃষকের উন্নতি না হলে কৃষির উন্নতি অব্যাহত থাকবে না। ফলে দেশের উন্নতি ব্যাহত হবে। খাদ্যে ভেজাল রোধকল্পে ভেজাল বিরোধী অভিযানের পক্ষে তিনি জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। তার অন্যান্য লেখায় জমি ও আয় বণ্টন, হংকং ঘোষণা ও শাফটা, সেচ ব্যবস্থা, কৃষি বাজেট বিন্যাস এবং বন্যার বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। আর প্রত্যেকটি বিষয়ই সরাসরি বা সঙ্গত কারণে এই বই-এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট।