রবীন্দ্র-ছোটগল্প পাঠের ভূমিকা বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ এক অসাধারণ কালজয়ী সৃষ্টি। উপকরণ বৈচিত্র্য, বিষয়ভাবনা ও শিল্পরূপ নির্মাণের অভিনবত্বে বিশ্বসাহিত্যেও এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। রবীন্দ্রনাথই একমাত্র প্রতিভা, যাঁর কথাসাহিত্য যেকোনো বয়সের মানব-মানবীকে তাদের উপলব্ধি অনুযায়ী উপভোগ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। একটা সমাজ সকল বয়সের মানুষের সমষ্টি এবং সেই সমষ্টি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের স্রোত রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোতে সময়ের ইতিহাস হয়ে ধরা পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, কবিতা, গান কিংবা উপন্যাস পাঠক হৃদয়ে নিজ নিজ উপলব্ধি অনুযায়ী প্রকাশ পেয়েছে। যে কারণে প্রতিটি গল্পের তাৎপর্য পাঠকের উপলব্ধি ও বোধ অনুসারে স্বতন্ত্র রূপ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত কিশোর গল্প সংকলনের গল্পগুলো পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারব মানবজীবনের ভেতর-বাহিরকে তিনি কতটা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁর সাহিত্যকর্মে সেই প্রত্যক্ষ মানবজীবন কী অসাধারণভাবে রূপায়িত হয়েছে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কলকাতা শহর ছেড়ে জমিদারি দেখাশোনা করতে বর্তমান বাংলাদেশের শিলাইদহ, শাহাজাদপুর ও পতিসর অঞ্চলে অনেকটা সময় থাকতে হয়েছে। পিতা প্রদত্ত দায়িত্বের নতুনত্ব এবং জটিলতা ঠিকমতো পালন করেও রবীন্দ্রনাথ যে অভিজ্ঞতার জগৎ আবিষ্কার করেন, সেটা অভিনব এবং বাংলা সাহিত্যের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ ও নওগাঁ- এই তিনটি জেলায় জমিদারি স্টেট তদারকি করতে গিয়ে এই অঞ্চলের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। কবির মন এই নতুন অভিজ্ঞতায় সৃষ্টির এক ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করল। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান শুনেছেন কিংবা কবিতা পাঠ করেছেন, তাঁদের কাছে এই নতুন অভিজ্ঞতার গল্পগুলো বিস্ময়কর অনুধাবনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জীবনকে দেখা এবং রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্পকৌশলের দিক থেকে অনন্যতা লাভ করেছে। কবিমনের আবেগ দিয়ে জীবনকে দেখতে গেলে জীবনের বাস্তবরূপ অনেক সময় বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ কুশলতায় কবিসত্তার উপলব্ধি ও আবেগের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার মিলনে গল্প রচনা শুরু করেন। এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত প্রথম গল্প পোস্টমাস্টার মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারব, রবীন্দ্রনাথের কবিমন আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মিলনে গড়ে ওঠা কথকতার জগতটি কত অভিনব ও আকর্ষণীয়। এই গল্পের প্রধান চরিত্র পোস্ট্র্যাস্টার। কিন্তু তার কোনো নাম নেই। পেশাগত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে নগরজীবন এবং গ্রামজীবনের পার্থক্যের স্বরূপ তুলে ধরার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আয়োজন যেকোনো পাঠককে অভিভূত করে। রবীন্দ্রনাথ গল্পের শুরুতেই পোস্টট্রাস্টারের যে পরিচয় তুলে ধরেন, তা থেকেই তাঁর জীবনকে দেখার বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে: আমাদের পোস্টমাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যে-রকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্টমাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে তাঁহার আপিস; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল। কুঠির গোমস্তা প্রভৃতি যে-সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্রায় নাই এবং তাহারা ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে উপমা সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ শুরুতেই পোস্টট্রাস্টার চরিত্রের স্বরূপ ও ভবিষ্যৎ তুলে ধরেন। 'জলের মাছকে ডাঙায় তোলার' সঙ্গে উলাপুর গ্রামে আগত পোস্টট্রাস্টারের তুলনা করা হয়েছে। পোস্টট্রাস্টারের সঙ্গে তার একমাত্র ঐ গৃহের সঙ্গী গ্রামের এক কিশোরী মেয়ে রতন, এই মেয়ের পরিচয় দানের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ সংক্ষেপে যে তথ্য উপস্থাপন করেন, তা থেকেও আমরা মেয়েটির পুরো জীবনরূপকেই উপলব্ধি করতে পারি: পোস্টট্রাস্টারের বেতন অতি সামান্য। নিজে রাঁধিয়া খাইতে হয় এবং গ্রামের একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা তাঁহার কাজকর্ম করিয়া দেয়, চারিটি-চারিটি খাইতে পায়। মেয়েটির নাম রতন। বয়স বারো-তেরো। বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না। কলকাতার শহর বিচ্ছিন্ন গ্রামের অপরিচিত পরিবেশের মধ্যে নিজের মা, ভাই- বোন এবং কলকাতা জীবনের অভিজ্ঞতা বলার মতো কোনো সঙ্গী তাঁর ছিল না। নীলকুঠির গোমস্তাদের কাছে এইসব প্রসঙ্গের কোনো তাৎপর্যও ছিল না। সুতরাং জীবনের এইসব গল্পকথা অশিক্ষিতা ক্ষুদ্র বালিকার কাছেই তিনি বলে যেতেন। এভাবেই পরিস্থিতির রসায়নে উলাপুরের নিঃসঙ্গ জীবনে গ্রামের এক ক্ষুদ্র বালিকাই পোস্টট্রাস্টারের একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে। গল্পটি ক্রমান্বয়ে বাইরের অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে মানুষের মনের জগতে প্রবেশ করে। বালিকা রতনের সঙ্গে পোস্টাস্টারের এই অসম কিন্তু একান্ত সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অপরিচিত নতুন পরিবেশের সঙ্গে পোস্টট্রাস্টার শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং উলাপুর গ্রামের জগৎ থেকে অন্য কোথাও বদলির জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। তার আবেদন মঞ্জুর হয়। অনেক রাতের গল্পকথা, অসুস্থতাকালে ক্ষুদ্র বালিকার সেবাযত্ন সূত্রে রতনের সঙ্গে যে মমতার সম্পর্ক তৈরি হয়, তার যবনিকার সময় চলে আসে। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট্ট গৃহের মধ্যে মায়া- মমতার যে অভিনব সম্পর্কের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, সেটা হয়তো শহরের ছেলে পোস্টাস্টারের হৃদয়ে তেমন তাৎপর্য বহন করেনি; কিন্তু মনের অজান্তে আশ্রয় এবং নির্ভরতার যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার মূল্য বালিকা রতনের কাছে ছিল অপরিসীম। আত্মপ্রকাশের ভাষা এই ক্ষুদ্র বালিকার মধ্যে থাকার কথা নয় এবং ঘটনার অনিবার্যতা প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতাও তার নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।