জীবন কেন, এই জীবনের অর্থ কী, কেনই-বা শুধুমাত্র বেঁচে থাকা? নাকি এর গভীরে নিহিত আছে কোনও হিরন্ময় তাৎপর্য?—এমন নানা প্রশ্নে আকীর্ণ বস্তুগ্রাহ্য এই জগৎ ও জীবন। সাহিত্যে ধ্রুপদীয়ানার সনিষ্ঠ সেবক শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়ের এই বৃহদায়তন উপন্যাসে এই সমূহ সনাতন প্রশ্নেরই স্থির উত্তর-অন্বেষণ। আর দশটা উপন্যাসের মতােই এই উপন্যাসেরও উপকরণ কিছু চরিত্র আর কিছু ঘটনা, সেইসঙ্গে মানুষের অভ্যন্তরে প্রবহমান চৈতন্যের গুঢ়, গভীর স্রোত। তবু শাশ্বত সাহিত্যে যেমন, এখানেও তেমনই, এক গভীর দ্যোতনা এ-কাহিনীর শুরু ও শেষকে তাে বটেই, এমনকি পুরাে কাহিনীকেও এক সময় অতিক্রম করে যায়। এখানেই এর সার্থকতা ও অনন্যতা।
‘দেশ’ পত্রিকায় দীর্ঘকাল ধরে প্রকাশিত হবার সময় থেকেই পার্থিব সর্বস্তরের পাঠকের অভিনন্দনধন্য। এ-কাহিনীর পঞ্চ প্রবাহ শহর-গঞ্জ-গ্রামকে পরিব্যাপ্ত করে শহুরে ও গ্রামীণ জীবনে জড়িয়ে-থাকা অজস্র মানুষের আখ্যান-উপাখ্যানকে নিয়ে চলেছে এক অনিকেত পরিণতির আশ্চর্য মােহনায়। এ-উপন্যাসের উন্মােচন ঘটেছে এক অজ পাড়াগাঁয়ে, যেখানে বৃদ্ধ বিষ্ণুপদ তার ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে প্রত্যাশায় চেয়ে থাকে সামনে তার মেজো ছেলের অর্ধসমাপ্ত পাকা বাড়িটির দিকে। এই সামান্য দৃশ্য থেকে শুরু হয়ে এ-উপন্যাস ক্রমশ নানা প্রবাহে। জীবনের নানা দিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে, উন্মােচিত হতে থাকে জীবনের দেখা ও অদেখা নানান রূপ-বর্ণ-ছন্দ। এক দিকে বিষ্ণুপদর তিন পুত্র কৃষ্ণজীবন, রামজীবন, বামাচরণ, কন্যা বীণাপাণি ও তার স্বামী নিমাই, অন্য দিকে হেমাঙ্গ, চারুশীলা, চয়ন, ঝুমাদি, অনু, মনীশ, অপর্ণা, অনীশ, আপা ও তাদের অনুষঙ্গে সম্পর্কিত আরও অনেক মানুষ। এইসব মানুষের টানাপােড়েনে তৈরি হয়েছে আরেক বিচিত্র বিশ্ব, যেখানে সনাতন ঐতিহ্যবাহী স্বাদেশিক প্রেক্ষিতে আধুনিক সভ্যতার দ্বন্দ্বদীর্ণ চিত্রণ।
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তার। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। মাধ্যমিক পাস করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। পরে কলকাতা কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তার পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বইপড়ুয়া ছিলেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পড়তেন। খুব ছোটবেলাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ে শেষ করেছেন। এই পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই এর সংখ্যা দু’শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পার্থিব, দূরবীন, মানবজমিন, গয়নার বাক্স, যাও পাখি, পারাপার ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রহস্য সমগ্র রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রায় ৪০ এর অধিক রহস্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘অদ্ভুতুরে সিরিজ’ নামকরণে। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ভুতুড়ে ঘড়ি, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নন্দীবাড়ির শাঁখ, ছায়াময় ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমূহ দুই বাংলায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সমানতালে। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমগ্র অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার উপন্যাস ‘যাও পাখি’ এবং ‘মানবজমিন’ নিয়ে বাংলাদেশেও ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র শাবর দাশগুপ্ত এবং ধ্রুব পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র জন্য ১৯৮৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ পান। ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেন ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। এছাড়াও, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ লাভ করেন তিনি।