সময় অনেক কিছু পালটে দেয়। কবিতার নানা যুগ, নানা উত্থানপতনের মধ্য দিয়েও কবিতা সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এদেশের জাতীয় জীবনে যেমন, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের কবিদের কবিতায় শুধু নয়, ওপার বাংলার কবিদের কবিতায়ও বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নের ধারাকে সমৃদ্ধ করতে লেখক, কবি, গবেষকরা কাজ করতে থাকেন। ১৯৭১—এ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা—উত্তর কবিতাকে এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বলা চলে। কারণ, এ সময় কবিতায় বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধের আবেগ ও অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। কবিতায় উঠে এসেছে তীব্র আবেগ, দ্রোহ আর প্রেম। এ সময়টাতে কবিতা অনেক বেশি জীবন ঘনিষ্ঠ এবং মাটি ও মানুষের কাছাকাছি চলে যায়। তখনকার কবিতা ব্যক্তিগত সুখ—দুঃখ বা বেদনাবোধের পরিবর্তে সমষ্টির চেতনাকে অধিক রূপায়িত করেছে। কবিতার চিরচেনা ভাব ও ভাষাকে বাদ দিয়ে তৎকালীন কবিরা অনমনীয় ও বিষয় নির্ভর কবিতা রচনার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন।
স্বাধীন দেশের মুক্ত পরিবেশে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কিন্তু স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যা প্রত্যাশা করেছিল, সে প্রত্যাশা পরাভূত হয়। এ দেশে নানা অঘটনের জন্ম হয়। রাজনৈতিক সংকটসহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আশাহত বাঙালি বঞ্চনার বেদনায় মুষড়ে পড়ে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে কবিরাও বিচ্ছিন্ন ছিল না।। এসবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল কবি দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, কবি রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো’ এবং কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর “বাতাসে লাশের গন্ধ” ইত্যাদি কবিতায়। স্বাধীনতা—উত্তর কবিতায় প্রেম ও বিপ্লবকে কবিরা সমার্থক বিবেচনা করে তাঁদের কাক্সিক্ষত ভুবনকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়েছেন। এ কারণে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিপ্লবী কবিতার পাশাপাশি অজস্র প্রেমের কবিতাও রচিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে কবিতা অবলীলায় জীবনের কথা, মানবতার কথা, সংগ্রামের কথা বলেছে এবং বলবে। বরাবরই কবিতা ছিল অবিভক্ত বাংলার জাগ্রত জনতার প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। আমরা রাষ্ট্র ভাগ করেছি, সমাজ ভাগ করেছি, ধর্ম নিয়ে অনেক মাতামাতি করেছি এবং করছি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্বকে দ্বিখন্ডিত করতে পারিনি। এপার বাংলা—ওপার বাংলার মেলবন্ধন তৈরি করে দিয়েছে কবিতা ও বাংলা সাহিত্য। আর ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পর বঙ্গীয় সত্তাকে রক্তাক্ত বর্ণমালার বন্ধনে আরও সুদৃঢ় করেছে বলে আমি মনে করি।