আসুন। আমার বাগান দেখলেন? সব গোলাপ ফোটেনি এখনো, সবে তো মে মাস পড়লো। আমি সাত রঙের গোলাপ করেছি : দু-রকম হলদে, দু-রকম গোলাপী, দু-রকম লাল। আর শাদা, অবশ্য। আমার হাতের মুঠোর মত বড়ো হয় এক-একটা। ফুলের মধ্যে গোলাপ আমার প্রিয়। কেন জানেন? ওটা বিদেশী, তবু এ-দেশের হ’য়ে গেছে। মোগলরা নিয়ে এলো ভারতে, ইরান থেকে দুনিয়ায় ছড়ালো। গোলাপ : কথাটাই অর্ধেক ফার্শি, অর্ধেক সংস্কৃত। যাকে বলে আন্তর্জাতিক মিলন, তারই একটা নিশেন যেন। আমি আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী।
না, না, আমার কোনো অসুবিধে নেই, কোনো কাজ নেই—আপনি বসুন, যতক্ষণ ইচ্ছে। আমার এই বাড়ী, বাগান অনেকেই দেখতে আসেন—উট-কামণ্ডের একটা দ্রষ্টব্য হ’য়ে গেছে এটা। ও-পাশের জাপানী বাগানটা দেখেছেন কি? আঁকাবাঁকা ঝিল, চেরি গাছে কুঁড়ি ধরেছে, দু-এক পশলা বৃষ্টি হ’লেই শালুক ফুটবে। অনেকে সূর্যাস্তের সময় বেড়াতে আসে সেখানে। আমি কাউকে বাধা দিই না, আমার এই দুটোমাত্র চোখ দিয়ে কত আর দেখবো, সুন্দর মানেই বহুভোগ্য—তা-ই নয়? আর আমার এখনো এটুকু দুর্বলতা আছে যে অন্যের মুখে প্রশংসা শুনলে ভাল লাগে। কিন্তু যে যা-ই বলুক, এতে অসাধারণত্ব কিছুই নেই, এরকম হাজার হাজার বাগান আছে পৃথিবীতে। আমি তো সাতের পরে অষ্টম রং যোগ করতে পারিনি। জানেন, একবার আমার খেয়াল চেপেছিলো অন্য রঙের গোলাপ করবো। নীল, বা বেগনী, বা কালো—কালোই বা কেন হবে না? জাপান থেকে, হল্যাণ্ড থেকে বিস্তর বই আনিয়েছিলুম। উত্তেজনায় ঘুমোতে পারি না রাত্রে। কাঁপছি, যেন একটা চোরাকুঠুরির চাবি আমার হাতে এসে যাচ্ছে। পৃথিবীতে কালো ফুল নেই কেন? ফুল, ফল, শস্য—যা-কিছু মাটি ফুঁড়ে বেরোয়, তাদের রং কেন রামধনুর সাতটির মধ্যেই বাঁধা প’ড়ে আছে? শাদা, যাতে সব রং মিলে-মিশে আছে, ফুলেদের মধ্যে তাও পাওয়া যায়, কিন্তু কালো—যাতে সব রং লুপ্ত, তা কেন নেই? সত্যি কি নেই, না কি আমরা এখনো খুঁজে পাইনি? সে কি হবে না ভগবানের চেয়েও বড়ো, যার হাতে প্রথম ফুটবে কালো গোলাপ? সে যদি আমিই হই?...আপনি ভয় পাবেন না, আমি পাগল হ’য়ে যাইনি, যখন আমি নীল গোলাপের স্বপ্ন দেখছি তখনই আমি জানি ওটা হবার নয়। একরকমের খেলা আরকি নিজের সঙ্গে, সময় কাটানো—সামথিং ইন্টরেস্টিং টু ডু, দ্যাট’স অল।
Buddhadeb Bosu- তিনি নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ'র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।