স্কুলজীবনে অর্থাৎ গত শতাব্দীর সত্তর সালের আগে কলেজিয়েট স্কুলের আমার সহপাঠীদের অনেকের সঙ্গেই বিকেলে পুরনো ঢাকার কোনো স্থানে বসে গল্পগাছা হতো, কিন্তু সাহিত্যের ভাষায় সেটাকে ‘আড্ডা’ বলা ঠিক হবে না। আড্ডাটা একেবারে নিয়মিত শুরু করি ঢাকা কলেজে আইএসসি ক্লাসে ভর্তি হওয়ার পর। এর একাধিক কারণ ছিল, এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কারণটি সম্ভবত কলেজে উঠে নির্জলা স্বাধীনতা, স্কুলের হোস্টেলে শিক্ষকদের চোখের সামনে দিনরাত থেকে যা পাওয়া সম্ভব হয়নি। স্কুলের হোস্টেলে প্রায় এক ডজনের কাছাকাছি শিক্ষকদের সঙ্গে আমরা দুজন মাত্র ছাত্র থাকতাম, তাই তাঁদের রক্তচক্ষুর ভয় ছিল। আর কলেজে ওঠার পর রাতারাতি বয়স বাড়েনি, কিন্তু মানসিকভাবে বয়সটা অনেক বেশি বোধ হচ্ছিল নিজের কাছে। তাই শুধু কলেজ—হোস্টেলের সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে নয়, নিউ মার্কেটে দু—তিনটি রেস্তোরাঁয় আমার কয়েক বছরের সিনিয়র কবি ও কথাশিল্পীদের সঙ্গে সদ্য পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের অনুঘটক ছিলেন নিউ মার্কেটের একটি রেস্তোরাঁর বেয়ারা কবি রফিক। রফিক দু—তিন দিনের মধ্যেই আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। এখানেই কবি আবিদ আজাদ, কবি শিহাব সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কয়েকজন সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ফরিদপুরের বড়ো ভাই রব্বানী ভাই। এখানেই আড্ডাটা প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক ঘণ্টা ধরে চলত, যা নেশায় পরিণত হয় দিন কয়েকের মধ্যেই! ততদিনে কলকাতার ‘দেশ’ ও অন্যান্য সাহিত্যপত্রিকা যা চোরাপথে ঢাকায় আসত, সেগুলোর মাধ্যমে ‘কবিতা’, ‘পরিচয়’ বা অন্য দুয়েকটি পত্রিকায় যে—সাহিত্য আড্ডা হতো সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে যাই, বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিচারণ ও অন্যান্য লেখায়। তাই মননশীল সাহিত্য আড্ডা কেমন হয় বা হওয়া উচিত এ সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা আমার মনে গড়ে ওঠে। পরচর্চা বা খবরের কাগজ পাঠ করে হালকা রাজনীতির ভেজাল—মিশ্রিত সমাজের কড়চা যে সাহিত্য আড্ডা নয় এ বিষয়ে আমার একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়, যদিও আমার অধিকাংশ সহপাঠী ও বন্ধুরা আড্ডা বিষয়ে আমার ধারণাকে কিছুটা নাক উঁচু বলে মন্তব্য করতেন। এভাবেই ঢাকা কলেজের প্রথম কয়েক মাস আড্ডার সঙ্গে আমার পরিচয়, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই আমি আর আমার ঢাকা কলেজের সহপাঠী ওসমান হোসেন খান লাইব্রেরিপাড়ায় যাতায়াত শুরু করি আড্ডা দেয়ার ইচ্ছায়। তখন শুধু আলোচনার বিষয় বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়ার রীতিনীতি বা সম্ভাব্য চেষ্টা, আমাদের কারো কারো রেজাল্ট নিয়ে কিছুটা উদাসীনতা ছিল। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মাস দেড়েক পরই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই কয়েক বন্ধুর সঙ্গে, কিন্তু সারা দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়াতেই আড্ডায় কাটাই।
কালেভদ্রে কখনো জাহাঙ্গীরনগরে গেলেও সেখানে ছাপরার দোকানে ডাইলপুরি ও কাপের পর কাপ চা খেয়ে কোনো ক্লাস না করে আড্ডা দিয়ে চলে আসি। জাহাঙ্গীরনগরের আড্ডার বিশেষত্ব ছিল মাঝে মাঝে জনা দু—তিনেক শিক্ষকও আমাদের সঙ্গে পুরির ছাপরার দোকানে আড্ডা দিতেন। এখানে আড্ডার একমাত্র বিষয় ছিল সাহিত্য ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখা! এদের মধ্যে দুজন ইংরেজি বিভাগের এবং একজন বাংলা বিভাগের। বাংলা বিভাগের এই শিক্ষক পরে নাট্যকলা বিভাগ সৃষ্টি হলে সেখানে চলে যান।
আবেদীন কাদের ১৯৫৫ সালে শরীয়তপুরের জাজিরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে তথ্য ক্যাডারে সরকারি চাকরিতে যােগ দেন। ১৯৯৩ সালে পড়াশােনার জন্য নিউইয়র্ক যান । নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Communications-এ এমএ এবং নিউ স্কুল থেকে Political Sociology-তে এম.ফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি নেন। ২০০১ সাল থেকে নিউজার্সির এসেক্স কলেজে সমাজবিজ্ঞান পড়ান। এছাড়া খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে সমাজবিজ্ঞান পড়ান। নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫ সাল থেকে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে লেখা শুরু। মূলত প্রবন্ধ লেখেন গবেষণা, পড়াশােনা এবং আগ্রহের বিষয় সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান। তিনি সেলিনা হােসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড এবং ইমদাদুল হক মিলনের পরাধীনতা উপন্যাস দুটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। এছাড়া দেশের কয়েকজন লেখকের গল্প ও কবিতাও ইংরেজি অনুবাদ করেন বড় বেদনার মতাে বেজেছ ছাড়াও তার আরাে একটি প্রবন্ধের বই দ্বীপান্তরের গান। ইংরেজি প্রবন্ধের বই একাধিক। এ-বছরের নতুন oligala Media State and Other Essays. তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তেরাে। ১৯৯৩ সাল থেকে আবেদীন কাদের নিউইয়র্ক প্রবাসী।