সকল প্রশংসা মহিমান্বিত আল্লাহর জন্যে। তিনি এক ও একক-লা শরীক। তামাম বিশ্বজুড়ে তাঁর প্রবল প্রতাপ। আপন বান্দাদের সহজাত ভুল-ত্রুটির প্রতি তিনি ক্ষমাশীল। তিনি এমন এক সত্তা, যিনি রাতের পর্দা দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। তিনি হৃদয়বান, বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে এর ভেতর শিক্ষা ও উপদেশের ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টির ভেতর থেকে থাকে নির্বাচন করেছেন, তাকে দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত করে দিয়েছেন এবং তার হৃদয়-চক্ষুকেও উজ্জল করে দিয়েছেন। কাজেই যে ব্যক্তি মুরাকাবায় আত্মনিমগ্ন থাকে, আল্লাহর সত্তায় আত্মলীন হবার আকাক্সক্ষায় সে খোদায়ী আনুগত্যে সর্বদা মশগুল থাকে। জান্নাত লাভের প্রবল আগ্রহে সে সর্বক্ষণ আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজে নিয়োজিত থাকে এবং তাঁর অসন্তুষ্টি সৃষ্টিকারী সকল কর্মকাণ্ডের প্রতি সে চক্ষু বন্ধ করে রাখে। অনুরূপভাবে জাহান্নামের আযাব সম্পর্কে হামেশা সে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। সে এ ব্যাপারেও আল্লাহর শোকর আদায় করে যে, অবস্থা ও পরিবেশের পরিবর্তন সত্ত্বেও তিনি তাকে দ্বীন ইসলামের সহজ-সরল পথে অবিচল থাকার তওফিক দান করেছেন। অতএব, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, যিনি দয়াবান অনুগ্রহশীল ও মেহেরবান; আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ # আল্লাহর বান্দাহ, তাঁর রাসূল, তাঁর বন্ধু ও তাঁর প্রিয়পাত্র; যিনি আমাদেরকে সরল সঠিক পথ নির্দেশ করেছেন, এবং নির্ভুল দ্বীন তথা জীবন পদ্ধতির দিকে আহবান জানিয়েছেন, তাঁর প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক, সেই সঙ্গে তামাম নবী রাসূল (আ.), তাঁদের সকল পরিবারবর্গ এবং সকল পূণ্যবান সৎকর্মশীল লোকদের প্রতি শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন :
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنِّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونَ - مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونَ
‘আমি জ্বিন ও মানুষকে শুধুমাত্র আমার বন্দেগী (দাসত্ত্ব) করার জন্যেই সৃষ্টি করেছি; আমি তাদের কাছে থেকে যেমন কোনো প্রত্যাশা করি না, তেমনি তারা আমায় পানাহার করাবে তাও চাইনা ।’
এ থেকে জানা গেল যে, জ্বিন ও মানুষকে সৃষ্টি করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, বন্দেগী বা দাসত্ব করা । অতএব তাদের কর্তব্য হলো, যে উদ্দেশ্যে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য সাধনেই তারা নিরত থাকবে। এবং পার্থিব লক্ষ্য অর্জন থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে। প্রত্যেকের মনেই একথা দৃঢ়মূল করে নেয়া দরকার যে, দুনিয়া ধ্বংসশীল এক জগত। এর কোনো চিরস্থায়িত্ব নেই। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়া হচ্ছে দ্রুত ধাবমান সওয়ারীর মতো। এটা আনন্দ-উৎসবের কোনো স্থান নয়, এটা এমন এক সরোবর, যার পানি একদিন না একদিন শুকিয়ে যাবেই। এ কারণে দুনিয়ায় আল্লাহ্র বন্দেগী করার যোগ্য হলো সেই ব্যক্তি, যে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগায় এবং দুনিয়ার আকর্ষণ ও চাকচিক্যকে এড়িয়ে চলে।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন :
إنَّمَا مَثَلُ العبوة الدُّنْيَا كَمَا أَنزَلْتُهُ مِنَ السَّمَاء فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالْأَنْعَامُ ط حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَالزَّيِّنَتْ وَظَنْ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَدِرُونَ عَلَيْهَا لا أَنْهَا أَمْرُنَا لَيْلا أَوْنَهَارًا فَجَعَلْنَهَا حَصِيْدًا كَانْ لَّمْ تَعْنَ بِالْأَمْسِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত হলো এ রকম, আমরা আসমান থেকে পানি বর্ষণ করলাম তার সাহায্যে (দুনিয়ার বুকে) বৃক্ষ-লতা বেশ ঘন হয়ে উঠল যা মানুষ ও পশুকুল আহার করে থাকে, এমন কি সেই ভূমি যখন সজীবরূপে সুসজ্জিত ও সুবিন্যস্ত হয়ে উঠল এবং তার মালিকরা মনে করে বসল যে, তারা এর ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ঠিক তখন কোনো রাতে কিংবা দিনে আমাদের ভয়ংকর হুকুম (আযাব) জারী হলো। তারপর আমরা সেগুলোকে এমন শুকনা খড়কটোয় পরিণত করলাম যেন সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই ছিলনা। এভাবেই আমরা এমন লোকদের জন্যে নির্দশনগুলোর উল্লেখ করছি, যারা চিন্তা-ভাবনা পোষণ করে।
[সূরা ইউনুস, আয়াত নং-২৪]
এই ধরনের আয়াত (কুরআনে) প্রচুর পরিমাণে বর্তমান রয়েছে। একজন কবি এই ধরনের বিষয়বস্তুকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে বিবৃত করেছেন। কবিতাটির ভাবার্থ নিম্নরূপ ঃ “নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সমজদার বান্দাহ তারা যারা দুনিয়াকে বিদায় জানায়, অশান্তি ও ফিতনার প্রশ্নে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে, দুনিয়ার প্রশ্নে গভীর চিন্তা-ভাবনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীতি হয় যে, এ দুনিয়া মানুষের চিরস্থায়ী বাসস্থান নয় । তারা এ দুনিয়াকে গভীর সমুদ্র জ্ঞানে ভাসান তাদের সৎকর্মের তরী।”
অতএব, দুনিয়ার অবস্থা যখন জানা গেল এবং আমাদের অবস্থাও সুস্পষ্ট হয়ে উঠল সর্বোপরি আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্যও পরিষ্কার হয়ে গেল, তখন প্রতিটি বিচক্ষণ লোকের কর্তব্য হলো নিজেকে সৎলোকদের পথে চালিত করা এবং যথার্থ বুদ্ধিমান লোকদের পথ অনুসরণ করা এবং কাংক্ষিত লক্ষ্য পথে এগিয়ে চলার জন্যে সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করা। অতএব, তার জন্যে সবচেয়ে নির্ভুল এবং সকল পথের চেয়ে নিকটতম পথ হলো সহীহ হাদীসসমূহ থেকে পথ-নির্দেশ গ্রহণ করা, যা সাইয়্যেদুল আওয়ালীন ও আখেরীন হযরত মুহাম্মদ # থেকে বিশুদ্ধ সনদ সহকারে বর্ণিত হয়েছে ।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন :
وتعا ونُوا عَلَى الْبِرِّ والتَّقوا (المائده : ۲(
(ঈমানদারগণ)! পুণ্যশীলতা ও তাকওয়ার কাজে একে অপরকে সাহায্য করো। (সূরা মায়েদা, আয়াত নং-২)
রাসূলে আকরাম # থেকে একটি বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে :
وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ -
একজন মুসলমান যতক্ষণ তার অপর মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ ও তার সাহায্যে হাত বাড়িয়ে রাখেন ।
(মুসলিম, নাসাঈ ও তিরমিযী)
مَنْ دَل عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ -
রয ব্যক্তি কাউকে কোনো ভালো কথা জানিয়ে দেয়, তদনুযায়ী যে কাজ সম্পন্ন হবে, তার সওয়াব সেও পাবে। (মুসলিম ও আবু দাউদ)
তিনি আরো ইরশাদ করেন :
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْآخِرِ مِثلُ أُجُورٍ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أجُورِهِمْ سَيْنَا
‘যে ব্যক্তি (কাউকে) হেদায়েতের দিকে আহ্বান জানাবে, সেও হেদায়েত গ্রহণকারীর অনুরূপ সওয়াব পাবে। তাতে দু’জনের কারো সওয়াবেই ঘাটতি হবে না।’
এ প্রসঙ্গে তিনি হযরত আলী (রা.)-কে বলেন :
يُهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلا وَاحِدًا خَيْرٌ لكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ - فَوَاللهِ لَأَنْ
হে আলী! আল্লাহ যদি তোমার দ্বারা কাউকে হেদায়েত করেন, তবে সেটা তোমার জন্যে (অতি মূল্যবান) লাল উটের চেয়েও উত্তম' (বুখারী ও মুসলিম)