ঢাকা নওয়াব পরিবারের সন্তান নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহ ছিলেন নওয়াব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর বৈমাত্রের ছোট ভাই। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী গৃহ শিক্ষকের নিকট তিনি উত্তম শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর পিতা নওয়াব স্যার খাজা আহসানুল্লাহ ও পিতামহ নওয়াব স্যার খাজা আব্দুল গনির ন্যায় তিনি বড় মনের মানুষ ও দানবীর ছিলেন। পিতা নওয়াব আহসানুল্লাহর মৃত্যুর পর পারিবারিক প্রথানুযায়ী জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা সলিমুল্লাহ নওয়াবী দায়িত্ব নিলে প্রথমদিকে নওয়াবজাদা আতিকুল্লাহ নওয়াবের সাথে সৌহার্দপুর্ণ সম্পর্ক রাখেন। কিন্তু জনকল্যাণমূলক কাজ ও রাজনীতি করতে গিয়ে নওয়াব সলিমুল্লাহ যখন দেদারছে অর্থব্যয় করে ঢাকা নওয়াব এস্টেটকে অর্থ কষ্টে ফেলেন তখন তিনি তাঁর বিরোধিতা করেন।
উল্লেখ্য, ঢাকার কাশ্মীরি খাজাদের বিরাট পরিবারের সকলের সম্পত্তি একত্রিত করে যৌথ এস্টেট হিসেবে ঢাকার নওয়াব এস্টেট গঠিত হয়েছিল। ১৮৪৬ সালে সম্পাদিত একটি ওয়াকফনামা মূলে পরিবার প্রধান হিসেবে মোতাওয়াল্লী একক হাতে সব সম্পত্তি পরিচালনা করতেন এবং অন্যান্যরা অংশমত ভাতা পেতেন। নওয়াব আব্দুল গনির জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম ও রাজানুগত্যের দরুন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নওয়াব উপাধি দেয় এবং পরে উপাধিটা বংশানুক্রম করা হয়। উত্তরাধীকার সূত্রে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে সম্পত্তি অন্যদের হাতে যাতে না যেতে পারে সেজন্য প্রধানতঃ নিজ পরিবারের মধ্যেই তাদের বিয়ে শাদী হতো। কিন্তু এ সত্ত্বেও নানা কারণে খাজা পরিবারের লোকদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল এবং অনেকে নওয়াবের বিরোধিতা করতেন। এরা ছিলেন মূলত নওয়াবের ভাই, বোন কিংবা মেয়ের বংশধর। ব্রিটিশ শাসকদের সাথে ঢাকার নওয়াবের সুসম্পর্ক ছিল এবং তাদের সহায়তায় তিনি পরিবারের বিক্ষুব্ধ গ্রুপকে দমন করে রাখতেন। ১৮৮০ সালে ঐ বিক্ষুব্ধ গ্রুপ নওয়াবের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে অনেক টাকা পয়সা উড়িয়েও তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
১৮৮৫ সালে ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা নওয়াব পরিবারের ঐ বিক্ষুব্ধ গ্রুপ তাতে যোগ দেয়। কারণ ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনি ও আহসানুল্লাহ ছিলেন আলীগড়ের স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁর ন্যায় মুসলিম স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী। তারই সূত্র ধরে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ পরবর্তীকালে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠন করে এ দেশের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস পান। অন্যদিকে ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস ছিল হিন্দু মুসলিম ঐক্যে এবং উভয়ে একত্রে রাজনীতির মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকদের নিকট থেকে দাবি আদায়ে বিশ্বাসী। এই সূত্র ধরে ঢাকার নওয়াব পরিবারের বিক্ষুব্ধ গ্রুপ প্রথম থেকেই ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেয়।
নওয়াব সলিমুল্লাহর আমলে সম্পত্তি নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে খাজা আতিকুল্লাহ পূর্বকালের ঐ বিক্ষুব্ধ গ্রুপের সাথে যোগ দেন। এর ফলে কংগ্রেস পন্থী নওয়াব পরিবারের লোকেরা তাঁকে দলে টানেন এবং বংগবিভাগ বিরোধী কংগ্রেস পন্থী হিন্দুরা এই সুযোগটা লুফে নিয়ে রাজনৈতিক কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবিভাগকে স্থায়িত্ব দেয়ার মানসে ১৯০৬ সালে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ যখন ঢাকায় মুসলিম নেতাদের নিয়ে সম্মেলন করে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠন করছিলেন, কংগ্রেস পন্থীদের প্ররোচনায় সেদিন নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহ কলকাতায় অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিয়ে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ ও বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করেন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৯০৭ সালে যখন থাকা নওয়াব এস্টেট সরকারের কোর্ট অব ওয়ার্ডসের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল, তখন নওয়াবজাদা আতিকুল্লাহসহ পরিবারের সবাই সেটা মেনে নিতে বাধ্য হলেন। বঙ্গ বিভাগের পর নতুন প্রদেশে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে গেলে নওয়াবজাদা আতিকুল্লাহকে নওয়াবের নানাবিধ কর্মকান্ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যোগ দিতে দেখা যায়। কিন্তু ১৯১৫ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর পূর্বোক্ত বিক্ষুব্ধ গ্রুপের প্ররোচনায় খাজা আতিকুল্লাহ পুনরায় পরবর্তী নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহর বিরোধিতা করেন এবং মোতাওয়াল্লী পদের দাবিতে মামলা করেন। ঐ মামলায় হেরে গিয়ে খাজা আতিকুল্লাহ একজন ভাতা ভোগী জমিদারে পরিণত হন এবং ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় মন দেন। ঢাকা নওয়াব পরিবারের এক সময়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হওয়ায় খাজা আতিকুল্লাহর জীবন ও কর্ম বর্ণনার সাথে এই পরিবারের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ কর্মকা-ের সমকালীন চিত্র এই গ্রন্থে সম্যকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
Title
নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহর জীবন ও কর্মের আলোকে ঢাকা নওয়াব পরিবারের সমকালীন চিত্র
ড. মোঃ আলমগীর ১৯৫৮ সালের ২০ মার্চ ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানাধীন নাগপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মোঃ আবদুর রউফ ও মাতা বেগম সুফিয়া খাতুন। তিনি বিপ্রবগদিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে এসএসসি, শৈলকুপা কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিঅল থেকে ১৯৭৮ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৭৯ সালে এমএ পাস করেন। "বাংলার মুসলিমদের সমাজজীবনে ঢাকার নওয়াব পরিবারের অবদান" শীর্ষক অভিসন্দর্ভের প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ২০০০ সালে পি-এইচডি ডিগ্রী প্রদান করে। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রেজিস্ট্রেশন অফিসার পদে যোগদান করেন এবং ১৯৮৯ সালে উক্ত জাদুঘরের একটি শাখা আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে উপ-কীপার পদে নিযুক্ত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কীপার (ডাইরেক্টর), সংরক্ষণ রসায়নাগার বিভাগ পদে কর্মরত আছেন। ড. মোঃ আলমগীরের অনেকগুলো গবেষণামূলক প্রবন্ধ দেশী ও বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ড. মোঃ আলমগীরের অনেকগুলো গবেষণামূলক প্রবন্ধ দেশী ও বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ