নিয়তি পাহাড় বাস্তবেই বিরাজ করে ছোটনাগপুর মালভূমির পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল ঘেঁষা এক প্রান্তে। সেই পাহাড়ের গোড়ায় বাস করে বীরহোড় সম্প্রদায়ের মানুষ। এরা ভারতের অন্যতম বিপন্ন আদিম জনজাতি। কিছুদিন আগে পর্যন্তও এরা সম্পূর্ণভাবে বনবাসী ছিল। এক বন থেকে অন্য বনে ঘুরে বেড়াত। ধীরহোড় শব্দের অর্থই বনের মানুষ। এদেরই গল্প নিয়তি পাহাড়।
সঙ্গে আছে আরও ষোলোটি গল্প যার অধিকাংশই প্রেমের গায়। যে প্রেমের পাথে বাধা কখনও সমাজ, কখনও ধর্ম, কখনও নিতান্তই মানসিক বিকৃতি। কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রকৃত প্রেমই শেষ পর্যন্ত শেষ হাসিটা হাসে। কিছু গল্পে ধরা আছে একাকী মানুষের ক্লান্ত অন্তলোকের অন্তহীন বন্দু যা কখনওবা বাইরে এসে পাড়ে। দৃশ্যমান হয় বহির্বিশ্বের কাছে। বহির্বিশ্ব তখন অবাক হয়ে ভাবে পাগল নাকি।
বিমল লামার ছোটগল্প আক্ষরিক অর্থেই গল্প। কারণ প্রতিটা গল্পেই ঘটনার পরম্পরাগুলো গিয়ে উপনীত হয় একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিণতিতে। গল্পের গতিধারা হঠাৎ কোথাও মাঝপথে হারিয়ে মিলিয়ে বা বিলীন হয়ে যায় না। ফলে গল্প শোনার আশৈশব লালিত যে আবহমান রোমাঞ্চ তা ভরপুর মেলে তাঁর গল্পে। চরিত্রেরা উঠে আসে চার পাশের পৃথিবী থেকে, প্রায়শই সাব-অল্টার্ন পৃথিবী থেকে, তাদের রোজকার চেনা মুখের আড়ালে অন্য এক মুখ নিয়ে। তখন এক সাধারণ মানুষও হয়ে ওঠে অবিশ্বাস্য এক শক্তির আধার যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সব সাধারণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অসাধারণের বীজ। প্রয়োজনে যে কেউ । বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারে। চরিত্রেরা সব সময়ই লড়াকু হয়ে থাকে যারা শেষ হাসি হেসে যায় জীবনের প্রতিকূলতার মুখের ওপর। গল্পে আশাবাদী ইতিবাচকতা লক্ষণীয়।
তার গল্পে প্রকৃতির ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক গল্পেই প্রকৃতি নিজেই একটা সক্রিয় চরিত্র। যেন সে সজীব এক সত্তা যার নিজস্ব বক্তব্য আছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। গল্পের তৃতীয় মাত্রার মতো পশ্চাৎপটে বিরাজমান থাকে যারে চলনকে আরও গভীর করে। আরও জাগতিক। যেমন নিয়তি পাহাড় গল্পটি। এই গল্পে সব চেয়ে প্রবল চরিত্র নিয়তি পাহাড় নিজেই। বাকিরা যেন সব পার্শ্বচরিত্র। তারই সম্পূর্ণতা রক্ষা করার জন্যই জায়গা পেয়েছে গল্পে।
বিমল লামার জন্ম ৪ জুলাই ১৯৬৮ দার্জিলিং পাহাড়ের সিংতাম চা বাগানে এক চা-শ্রমিক পরিবারে। বাবা পুলিশের চাকরি নিয়ে সপরিবারে চলে আসেন হুগলি জেলায়। পড়াশোনা চুঁচুড়ার স্কুলে-কলেজে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। আইনের কলেজছুট। বর্তমানে রাজ্য সরকারি কর্মচারী, পুরুলিয়ায় কর্মরত। স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ছোটগল্পই জীবনের প্রথম প্রকাশিত লেখা। ‘দেশ’ পত্রিকা আয়োজিত ছোটগল্প প্রতিযোগিতায় পরপর দু’বার পুরস্কৃত। প্রথম উপন্যাস ‘নুন চা’। ‘রুশিকা’ লেখকের দ্বিতীয় উপন্যাস। ২০১৩ সালে পেয়েছেন জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় স্মারক সম্মান।