বাঁধনহারা-পাগলপারা নদীর মতো তাঁর সাহিত্য। তিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর সাহিত্য স্রোতস্বিনী কুলু কুলু প্রবাহিত হতে হতে ছুঁয়ে যায় দুপারের জনপদজীবন, মানুষের আনন্দ-আহ্লাদ, বৈরাগ্য, জীবনের গোপন সত্য। এক সাক্ষাৎকারে লেখক জানিয়েছেন: তখন আমার বয়স পনেরো বছর হবে, তখনও আমার পৈতে হয়নি। মা তখন আমার পৈতে দিলেন….. ব্রহ্মপুত্রে যখন আমি দণ্ডী ভাসাতে যাচ্ছি-দণ্ডী ঘরে তিন দিন থাকার পর ভোরবেলা-কাকভোর-মনে আছে শীতকালে সেই দণ্ড আর গেরুয়ার ঝোলা আর বস্ত্র তীব্র স্রোত ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দিলাম-লাঠিটা ভেসে যাচ্ছে, পাহাড়, আবছা আবছা পাহাড় দেখা যাচ্ছে, বিশাল একটা পৃথিবী আর ওই গেরুয়া ঝোলাটা ভেসে যাচ্ছে স্রোতে, এমন এক তীব্র বৈরাগ্য হল আমার ভেতর যে আমার মনে হয়েছিল আমি ফিরে যাবো কেন?
সাহিত্যে মানবজমিন-জীবনের কথা আঁকতে গিয়ে কখনও তাঁকে ভণিতার মেকি আশ্রয় নিতে হয় না।
বাংলা সাহিত্যের বিরল লেখকদের অন্যতম তিনি তাঁর সহজ সরল ভাষায় এক অনুপম গদ্যরীতি গড়ে তুলেছেন, যা একান্তই তাঁর নিজস্ব।
তিনি মনে করেন, এই পৃথিবীর বিপন্ন মানুষের জন্য কোথাও একটুকরো আশ্রয় আছে, জীবনের বিপন্নতার মুখ থেকে ফিরে দাঁড়াবার জন্য পায়ের তলায় আছে মাটি। এক জায়গায় তাঁর লেখক জীবন সম্বন্ধে শীর্ষেন্দু স্বয়ং বলেছেন; দারিদ্র্য, প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সঙ্গে করে আমার লেখালেখির ইতিহাসে একটাই রূপালি রেখা-সেটা হল আমার পরিশ্রম করা ও ধৈর্য ধরার ক্ষমতা। লেখালেখির পথটি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না মোটে, আরও শক্ত ছিল নিজস্ব শৈলীর সন্ধান পাওয়া। অর্থাৎ চারপাশের এত নিবিড় অবধারিত অন্ধকার সত্ত্বেও জীবনকে তিনি আলোর মুখ দেখাতে পারেন। তাই তাঁর লেখায় আমরা সর্বত্র দেখতে পাই মানুষ ও মানবতার জয়গান। এ ছাড়াও তাঁর উপন্যাসে চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দু এবং তাঁর পরিবেশনরীতি পাঠককে মুগ্ধ করে, নতুন উপন্যাস পড়তে উৎসাহিত করে তোলে।
লতিকা প্রকাশনী হইতে প্রকাশিত এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত ফেরিঘাট, কাঁচের মানুষ, বৃষ্টির ঘ্রাণ, আক্রান্ত, সুখের আড়াল, রক্তের বিষ ও ধূসর সময় তাঁর চিরজীবী লেখনীর বিজয়গাথা।
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তার। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। মাধ্যমিক পাস করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। পরে কলকাতা কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তার পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বইপড়ুয়া ছিলেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পড়তেন। খুব ছোটবেলাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ে শেষ করেছেন। এই পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই এর সংখ্যা দু’শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পার্থিব, দূরবীন, মানবজমিন, গয়নার বাক্স, যাও পাখি, পারাপার ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রহস্য সমগ্র রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রায় ৪০ এর অধিক রহস্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘অদ্ভুতুরে সিরিজ’ নামকরণে। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ভুতুড়ে ঘড়ি, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নন্দীবাড়ির শাঁখ, ছায়াময় ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমূহ দুই বাংলায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সমানতালে। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমগ্র অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার উপন্যাস ‘যাও পাখি’ এবং ‘মানবজমিন’ নিয়ে বাংলাদেশেও ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র শাবর দাশগুপ্ত এবং ধ্রুব পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র জন্য ১৯৮৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ পান। ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেন ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। এছাড়াও, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ লাভ করেন তিনি।